সংবিধানে কী ধরনের সংস্কার চায় রাজনৈতিক দলগুলো?
সোমবারের (২৫ নভেম্বর) মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে লিখিতভাবে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব পাঠাতে অনুরোধ করেছিল 'সংবিধান সংস্কার কমিশন'। সে পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কার কমিশন আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব পেতে যাচ্ছে।
জানা গেছে— দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার 'চেক অ্যান্ড ভ্যালেন্স'— ইত্যাদি বিষয় সংবিধান সংস্কার কমিটির নজরে আনবে বিএনপি।
এদিকে জামায়াতসহ প্রায় সবদল চায় সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি। জাতীয় নাগরিক কমিটি ১০০ আসনে সংখ্যানুপাতি ও চার বছর মেয়াদী সংসদে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব দেবে সংবিধান সংস্কার কমিটিকে। দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
সংখ্যানুপাতি নির্বাচন পদ্ধতি বিএনপি চায় না, কিন্তু জামায়াতসহ অন্যান্য ছোট দল, বামদল সবাই চায় সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় নির্বাচন।
এছড়া, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারে সবদলই প্রায় একমত। জামায়াত ছাড়া দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ প্রায় সবদলই একমত।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে অন্তবর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা দ্য বিজনেস স্টাডার্ডকে বলেন, "সবদলের ও বিভিন্ন অংশীজনের মতামতের পর সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি খসড় সবদলকে দেবে, তারা সেটাকে আরও যোজন–বিয়োজন করে আবার প্রস্তাবনা দেবেন, সেটাকে পরে চূড়ান্ত করে তারপর সরকার সংবিধানের খসড়ার ওপর একটি 'গণভোট' আয়োজনের চিন্তা করছে।"
বিএনপি কী চায়?
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "আমরা এখনও রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করিনি, তবে আমাদের প্রস্তাবে রাষ্ট্রের এ সর্বোচ্চ দুইজনের ক্ষমতার 'চেক অ্যান্ড ভ্যালেন্স' থাকার বিষয়টি উল্লেখ থাকবে।"
তিনি আরও বলেন, "পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না— এতে কেউ শেখ হাসিনার মতো আর অতি দানবীয় ফ্যাসিস্ট হতে পারবেন না। তবে এক মেয়াদ বিরতি দিয়ে আবার হতে পারবেন।"
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদে গঠন নিয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "এটা হবে সংসদের উচ্চকক্ষ, এর এমপি ১০০, ২০০, নাকি ৩০০ হবেন— তা এখনো আমরা সিদ্ধান্তে আসিনি। তবে প্রতিটি দল নিম্নকক্ষে তাদের আসনের ভিত্তিতে এমপি মনোনয়ন দেবে।"
"সমাজের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সবচেয়ে মেধাবী, উদ্ভাবনী জ্ঞানসম্পন্ন লোকেরা এ উচ্চকক্ষের এমপি হবেন। তারা রাষ্ট্রের পলিসি নির্ধারণ করবেন। তাদের জ্ঞানগর্ভ সংসদীয় আলোচনা নিম্নকক্ষে প্রভাব রাখবে বলে বিশ্বাস রাখি,"বলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের লক্ষ্যে বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের আলোকেই সংবিধানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করছে।
এরসঙ্গে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার— এই তিন বিষয়কে সংবিধানের মূলনীতি ঘোষণা করা, আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে না যাওয়ার প্রস্তাব থাকছে। সংবিধান, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ বিভাগের সংস্কারে দলীয় প্রস্তাব অনেকটা চূড়ান্ত করেছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন দ্য বিজনেস স্টাডার্ডকে বলেন, "আমরা সংবিধান সংস্কারের কোনো বিষয়ই চূড়ান্ত করিনি। সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটি সব দলের কাছ থেকে প্রস্তাবনা নিয়ে একটি খসড়া করবে, তারপর তারা সেটা প্রত্যেক দলকে দেবে, সেটা দেখে প্রত্যেক দল যাচাই-বাছাই করে দলীয়ভাবে তাদের প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করবে।"
"আমরাও সংস্কার কমিটির খসড়া পেলে দলীয় স্থায়ী কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আবার কমিটির কাছে পাঠাবো," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের সিনিয়র নেতারা জামায়াতসহ বাকি ছোট দলগুলোর 'সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি'র প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত নন বলে জানিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সংখ্যানুপাতি পদ্ধতির বাংলাদেশের মতো দেশে বাস্তবতা নেই। এতে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্টাতা না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ফলে বেশিরভাগ সময় ঝুলান্ত পার্লামেন্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
জামায়াত কী চাচ্ছে?
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও প্রস্তাবনা জমা দেবে সংবিধান সংস্কার কমিটিকে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করা, সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সন্নিবেশ করা এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম বাতিল করার প্রস্তাব দেবে জামায়াত।
এছাড়া, সংসদের প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করা, সংসদীয় বিরোধী দলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রাখা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা। জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাবনা দেওয়া হবে বলেও জানা গেছে জামায়াতে ইসলামী সূত্রে।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল হালিম দ্য বিজনেস স্টাডার্ডকে বলেন, "আমরা সংখ্যানুপাতিক, রাষ্ট্রপতি–প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মোঢয়ে ভারসাম্য রাখাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দেব। আমরা পেশীশক্তি রোধ, নির্বাচনে কালোটাকার প্রভাব কমানোসহ অন্তর্ভূক্তিমূলক একটি সংসদের জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতির প্রতি জোর দিচ্ছি। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটারের ভোট কার্যকর হয় এবং সেটার ভূমিকা থাকে সংসদে।"
রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যে ব্যাপারে আবদুল হালিম বলেন, "আমরাও চাই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা কমানো হোক, কিন্তু আবার এমন বেশি ক্ষমতাও বাষ্ট্রপতিকে দেওয়া যাবে না– যেখানে সংসদ অকার্যকর হয়ে যায়। সংসদকে সম্পূর্ণ কার্যকর রেখে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো যেতে পারে।"
বিএনপির দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের ব্যাপারটি জামায়াতের প্রস্তাবনায় নেই বলে আবদুল হালিম জানান।
অন্যান্য দল যা চাইছে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিও তাদের প্রস্তাবণা জমা দেবে সংবিধান সংস্কার কমিটিকে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সরোয়ার তুষার দ্য বিজনেস স্টাডার্ডকে বলেন, "আমরা চাই নতুন সংবিধান। সংসদের নাম হবে 'আইনসভা'। ১০০ আসনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হবে– যেটা হবে সংসদের উচ্চকক্ষ– যেটির নাম হবে জাতীয় পরিষদ এবং এর নেতৃত্বে থাকবেন রাষ্ট্রপতি।"
"আর ২০০ আসনে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে যেটা, সেটা হলো নিম্নকক্ষ— যার নেতৃত্বে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সংসদের মেয়াদ হবে ৪ বছর। ২ বছর পর ৫০ থেকে ৬০টি আসনে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে হবে। তবে এতে সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাই হবে, কিন্তু সরকার পরিবর্তন হবে না," যোগ করেন তিনি।
"এছাড়াও, সংবিধান ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলকে প্রথম রিপাবলিক ও ২০২৪ কে দ্বিতীয় রিপাবলিক ঘোষণার ঘোষণার প্রস্তাব জমা দেব আমরা," জানান তুষার।
সরোয়ার তুষার আরও বলেন, "আগামীতে সংবিধান পরিবর্তন এমপিদের ভোটে নয়, সরাসরি গণভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে হবে এবং কোনো বিল নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে আলোচনার পর রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে পাশ হওয়ার প্রস্তাবনাও থাকবে আমাদের।"
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক দ্য বিজনেস স্টাডার্ডকে বলেন, "আমরা সংখ্যানুপাতিক এবং দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষে, এবং রাষ্ট্রপতি যে এখন যেকোনো বিলে ১৫ দিনের মধ্যে স্বাক্ষর না করলেও সেটি পাশ হয়ে যায়— সেটি উঠিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করবো। আমরা চাই কোনো বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি না থাকলে তিনি আবারও সেটা আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাতে পারবেন।"
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, "আমরা সংখ্যানুপাতিক এবং দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষে। তবে আমরা চাই উচ্চকক্ষে ৩০০ এমপি হবেন, তারা বর্তমান মহিলা এমপিদের মতো মনোনীত না হয়ে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। প্রত্যেক দল নির্বাচনের আগে প্যানেল দেবে, সেখান থেকে দলীয় প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী উচ্চকক্ষে আসন পাবেন।"
এছাড়া, শুধু বিএনপি ছাড়া চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, এবিপার্টিসহ প্রায় সব দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতির পক্ষে।
অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া প্রায় সবদলই দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষে রয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী বলছে সবদল চাইলে দ্বি-কক্ষ সংসদের বিষয়টি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করার সুযোগ আছে। বিষয়টি নিয়ে খুব কঠোর মনোভাব নেই দলের ভেতরে।