বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ২৫ প্ল্যাটফর্মের উত্থান: ছাত্র আন্দোলন কোন পথে যাচ্ছে?
জুলাই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ন্যায়বিচার, সামাজিক অধিকার ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার লক্ষ্যে ২৫টিরও বেশি নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছেন।
জুলাই আন্দোলনের মূল চেতনাকে ধরে রাখতে গঠিত এসব প্ল্যাটফর্ম আওয়ামী লীগের বিচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে শতাধিক কর্মসূচি পালন করেছে।
এমনই একটি প্ল্যাটফর্ম মধ্যে 'বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ'। ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি ও 'জাতীয় বেঈমানদের' বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে প্ল্যাটফর্মটি।
নতুন সংগঠন তৈরির পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল ওয়াহেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '৫ আগস্টের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। কিন্তু ৮ আগস্টের পর সরকার ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে জুলাই স্পিরিটের ব্যাঘাত লক্ষ করায় আমরা নতুন সংগঠনের প্রয়োজন বোধ করি। সেখান থেকেই আমরা আওয়ামী লীগের বিচার ও ফ্যাসিবাদের উৎখাতের জন্য কর্মসূচি পালন শুরু করেছি।'
এর একদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে 'ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতা' ব্যানারে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে 'কফিন মিছিল' কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষের কারণে এই বিভক্তি বলে জানা গেছে।
গত ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কসহ ১৭ জন পদত্যাগ করেন। পরে ২৩ অক্টোবর 'গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন' নামে ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কর্মসূচি পালন শুরু করেন তারা।
ওই সময় পদত্যাগের কারণ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সমন্বয়কের বিতর্কিত কার্যক্রম, ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের প্রচেষ্টা, সরকারি দলের মতো আচরণ ও গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট-বিরোধী কাজের অভিযোগের কথা তুলে ধরেন পদত্যাগকারীরা।
একই কারণ দেখিয়ে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও সমন্বয়করা পদত্যাগ করেছেন।
'ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র-জনতা' ব্যানারের মুখপাত্র ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই আমাদের কৌশল ছিল রাজনৈতিক পরিচয় পরিহার করা। গণঅভ্যুত্থান শেষে সব ছাত্রসংগঠনের বৈঠকে আমাদের প্রস্তাবনা ছিল প্ল্যাটফর্মটি সার্বজনীন হবে। কিন্তু সেখানে অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের অবদান ও অংশগ্রহণকে যথাযথ স্বীকৃতি না দেওয়া সবাই নিজেদের মতো সংগঠন বানিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছে।'
তিনি অভিযোগ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারে প্রতিনিধি পাঠালেও আন্দোলনের মূল স্পিরিটকে ধরে রাখেনি। রাষ্ট্রপতি অপসারণ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা, নতুন সংবিধানসহ ৫ দাবির আন্দোলনেও তাদের কোনো কর্মসূচি নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান এনাম অভিযোগ করেন, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আহত হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। এ কারণে তিনি নিজের গঠনমূলক চিন্তা বাস্তবায়নে দুটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
তার একটি উদ্যোগ হলো 'জুলাই ম্যাসাকার আর্কাইভ'। এ আর্কাইভ বেসরকারি পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন উপাদান, যেমন ছবি, ভিডিও, কনটেন্ট তৈরিসহ বিভিন্ন কাজ বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরছে।
হাসানের আরেকটি উদ্যোগ হলো 'স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদ' গঠন, যার লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায় এবং ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
আন্দোলনের মূল চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে।
এসব প্ল্যাটফর্মের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট কোয়ালিশন, একতার বাংলাদেশ, জাস্টিস ফর জুলাই, ইনকিলাব মঞ্চ, নিরাপদ বাংলাদেশ, রক্তিম জুলাই, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি, জুলাই গণহত্যা বিচার নিশ্চিত পরিষদ, জুলাই বিপ্লব পরিষদ, বিপ্লবী সাংস্কৃতিক ঐক্য, স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি ও স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদ।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উম্মা ফাতেমার এক সতর্কবার্তার প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে এসব প্ল্যাটফর্ম।
১০ আগস্ট এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে উমামা ফাতেমা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে অকার্যকর করার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, এটি একটি আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম। এই আন্দোলনের মঞ্চকে রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিণত করলে গণঅভ্যুত্থান তার আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুত হবে।
সে সময় 'আমাদের বুঝতে হবে, কোথায় আমাদের থামতে হবে' উল্লেখ করে উমামা ফাতেমা সতর্ক করেছিলেন, আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তে গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ২১ নভেম্বর তিনি টিবিএসকে বলেন, 'ওই সময় সেটি আমার ব্যক্তিগত মত ছিল, কারণ সমন্বয়ক পরিচয়ে অনেকেই অরাজকতা করছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীরা দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদের প্রতিবাদ করলে টার্গেটেড হয়। আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা ও প্রতিহিংসার কবল থেকে বাঁচতেই সুসংহত হতে হয়েছে। এছাড়া ভুয়া সমন্বয়কদের দৌরাত্ম্যও কমানো দরকার ছিলো। আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে ঘোষিত ৫ দফায় আমরা এখনও অটল আছি। সরকারকে টেকসই রাখার স্বার্থে এখন বড় ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না।'
নতুন প্ল্যাটফর্মগুলোর বিষয়ে উমামা ফাতেমা আশা প্রকাশ করে বলেন, 'কোটা সংষ্কার আন্দোলনে সবার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণের কারণেই সেটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ পায়, যেখানে সব রাজনৈতিক মতাদর্শের ও নাগরিকদের অংশ ছিল। এখন তারা আবার ভিন্ন নামে প্ল্যাটফর্ম করছেন, আমরা সেটাকে স্বাগত জানাই। এসব প্ল্যাটফর্মের অনেকগুলো আমাদের কর্মসূচিতেও সংহতি প্রকাশ করেছে।'
গত সোমবার স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদ, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ ও ইনকিলাব মঞ্চের মতো সংগঠনগুলো ১৯টি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে একটি সভায় অংশ নেয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, পৃথক পৃথক প্ল্যাটফর্মের আত্মপ্রকাশ সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব।
এর আগে ১১ নভেম্বর ১৩টি নবগঠিত সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায় বসে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উপায়ে ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা নিয়ে আলোচনা করে।
সাম্প্রতিক এই বিভক্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন নতুন সংগঠনের উত্থান অস্বাভাবিক নয়। তবে এই প্রবণতা শিক্ষার্থীদের যৌথ দরকষাকষির ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা আরও বলেন, 'যেকোনো সংকট সমাধানে ঐকমত্য অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমানে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে যেমন ঐক্যের অভাব স্পষ্ট, তেমনি ছাত্র, রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্বও দৃশ্যমান।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, আলোচনা না হলে ছোট সমস্যাগুলো বড় সংকটে রূপ নিতে পারে, যার উদাহরণ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে।
তবে শিক্ষার্থী সমন্বয়কদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সরওয়ার তুষার এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।
তিনি বলেন, গণআন্দোলনের আগে গণতান্ত্রিক পরিসর না থাকায় তরুণরা আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও নতুন প্ল্যাটফর্মে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের পর তরুণদের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন দরজা খুলে যায়।
তুষার টিবিএসকে বলেন, 'তাদেরকে একটি প্ল্যাটফর্মে আটকে রাখা সম্ভব নয়। এখন মূল বিষয় হলো একটি অভিন্ন অবস্থান বজায় রাখা।'
তিনি আরও বলেন, তরুণদের চিন্তার পার্থক্য তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। আগে সবাই একটি সংগঠনের অধীনে কাজ করত। এখন তারা নিজের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সমান্তরালভাবে একসঙ্গে কাজ করছে।
ছাত্রদের দরকষাকষির ক্ষমতা কমবে—এমন ধারণার বিরোধিতা করে তুষার বলেন, 'আমি তা মনে করি না। তরুণরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে, যা ন্যূনতম ঐক্য নিশ্চিত করে। আদতে এটি তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায় আমরা তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান দেখেছি, বেশ কিছু কর্মসূচি যৌথভাবে আয়োজিত হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, এই প্ল্যাটফর্মগুলোর বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি নাগরিক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।