মিথ্যা মামলা, চাঁদাবাজি: জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মৃত্যু নিয়ে যেভাবে ব্যবসা
৬৪ বছর বয়সী দুলাল রবি দাস পেশায় একজন মুচি ছিলেন। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তিনি স্ট্রোক করে মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী দুলালের মৃত্যু পরিবারের সদস্যদের চরম সংকটে ফেলে দেয়। তবে তাদের দুর্ভোগ এখানেই শেষ হয়নি।
২৯ নভেম্বর তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় দুলালকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হত্যা করেছে। মামলায় ৪৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে ১৬৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আসামিদের তালিকায় আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
মামলার পরপরই কিছু আসামি ফোনে হুমকি পান, তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য অর্থ দাবি করা হয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আসামিরা দুলালের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
মৃত দুলাল রবি দাসের ছেলে বিকাশ দাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "আমরা চাই না কেউ আমার বাবার নাম ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করুক।"
বিকাশ প্রথম মামলাটির বিষয়ে জানতে পারেন তার সহকর্মী রকি ভূঁইয়ার কাছ থেকে, যার ভাইও আসামিদের তালিকায় রয়েছে।
বিকাশ বলেন, "আমার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল; তিনি হাসপাতালে যাওয়ার পথে স্ট্রোক করে মারা যান। আমাদের কাছে তার মৃত্যুসনদ রয়েছে।"
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রকি ভূঁইয়া জানান, তার ভাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলেন। কিন্তু কোনো পদে ছিলেন না। তিনি বলেন, "আমার ভাইসহ বিএনপির নয়জন নেতাকে এখন মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।"
মামলার এজাহারে কী বলা হয়েছে?
দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৮ জুলাই কিশোরগঞ্জের রথখোলা এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলি চালালে দুলালের বুকে গুলি লাগে। পরে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুলালের ছেলে বিকাশ দাস ইতোমধ্যে প্রধান বিচারিক হাকিমের কাছে আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, "যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে সামাজিক শান্তি নষ্টের চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।"
মামলাটি করেছেন রফিউল আলম নামে একজন ব্যক্তি। তার এজাহারে তিনটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, যার মধ্যে দুটি হত্যাকাণ্ড এবং একটি তার নিজের আহত হওয়ার ঘটনা।
এজাহারে অন্য হত্যাকাণ্ডে নিহত হিসেবে মো. রুবেল মিয়ার (৩৪) কথা বলা হয়েছে, যাকে ৪ আগস্ট সরকারবিরোধী আন্দোলনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবে শাহিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের মৃত্যুসনদ অনুযায়ী, রুবেল হার্ট অ্যাটাকের কারণে কার্ডিওরেসপিরেটরি ফেলিউরে মারা যান।
রুবেলের স্ত্রী মাজেদা আক্তার বলেন, "আমার স্বামীকে গুলি করা হয়নি। আমরা দুপুর ১১টা ৫৫ মিনিটে একটি ফোন পাই। ফোনে বলা হয়, রুবেলকে শ্বাসকষ্টের জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।" পরে পরিবারের সদস্যরা তাকে হাসপাতালে দেখতে যায় এবং অন্যত্র স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে।
রুবেলের বাবা আজহারুল ইসলামও প্রধান বিচারিক হাকিমের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। তিনি দাবি করেন, তার ছেলে আন্দোলনের সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং পরে মারা যায়।
কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের পর আমরা মামলা নথিভুক্ত করেছি। বাদী গণঅধিকার পরিষদের সমন্বয়ক এবং ওই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।"
তবে ৫ আগস্ট থেকে এ ধরনের আরও অনেক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে এবং হয়রানি ও ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এসব করা হচ্ছে।
মামলার বাদী রফিউল আলমের ভাষ্য
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহত হয়েছেন দাবি করে মামলার বাদী রফিউল আলম নিজেকে ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের "যোদ্ধা" হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, "আমি এখন আর গণঅধিকার পরিষদের কোনো পদে নেই।"
মামলার বিষয়ে রফিউল বলেন, "আমি যা দেখেছি তাই উল্লেখ করেছি। আন্দোলনের সময় আমাদের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন তারা। পরে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আমি এজাহারে যা দেখেছি, ঠিক তা-ই লিখেছি।"
তিনি আরও বলেন, "তারা আমার আন্দোলনের সঙ্গী ছিলেন। এজন্যই মামলা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, তদন্তে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটিত হবে।"
তবে সূত্রমতে, রফিউলের মামলার আসামিদের বেশিরভাগই স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং তিনি তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য অর্থ দাবি করছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড রফিউল এবং এক আসামির আত্মীয়ের কথোপকথনের একটি রেকর্ডিং পেয়েছে। সেখানে রফিউল নাম বাদ দেওয়ার জন্য একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, "আমি তার নম্বর দেব, তবে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। আমি সমস্যায় পড়লে আপনাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।"
ফোনালাপ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন রফিউল।
মিথ্যা অভিযোগের উত্থান
৫ আগস্ট সহিংস গণআন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশে মিথ্যা মামলা দায়েরের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
হত্যা মামলাগুলোতে প্রায়ই নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হচ্ছে এবং নাম বাদ দেওয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে অর্থ দাবি করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস)-এর ২৮ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাসব্যাপী সহিংস বিক্ষোভে ১,৫০০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং ২২ হাজার জনের বেশি আহত হন। পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, এ ঘটনাগুলো নিয়ে ২,৫০০টি মামলা দায়ের হয়েছে।
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের তিন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক ছাত্রলীগ নেতার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তারা অর্থ দাবি করেছিলেন।
২৭ অক্টোবর ফেনীতে একটি হত্যাচেষ্টার মামলায় ৮৫ জনকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর নামও রয়েছে।
ঢাকায় দীর্ঘ দুই দশক ধরে বসবাসরত ব্যবসায়ী ইব্রাহিম পাটোয়ারীকেও একই মামলায় আসামি করা হয়। তবে তিনি আদালত থেকে জামিন পান।
ইব্রাহিম দাবি করেন, ঘটনার সময় তিনি ঢাকায় ছিলেন। তিনি বলেন, "আমি ওই সময় ফেনীতে ছিলাম না। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে কোনো আন্দোলনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।"
সম্প্রতি ফেনীর আরও দুই মামলায় তাকে আসামি করার চেষ্টা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে বিএনপির জেলা নেতাদের সহায়তায় তিনি নিজের নাম বাদ দিয়েছেন।
ইব্রাহিম জানান, তিনি বিএনপি-সমর্থিত একটি পরিবারের সদস্য এবং তার দুই ভাই যুবদলের পদে রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, "বিএনপি পরিবারের সদস্য হয়েও আমাকে মানসিক হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে।"
ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিয়ে উদ্বেগ
মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, নিরপরাধ ব্যক্তিদের মিথ্যা অভিযোগে আসামি করা হচ্ছে। এর ফলে, মূল দোষীরা শাস্তি পাবে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদিন মালিক বলেন, "জুলাই মাসের আন্দোলন পরবর্তী মামলা এখন দুর্নীতির উৎসে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হচ্ছে। তাদের বেশিরভাগেরই কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না। তাদের কাছ থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য অর্থ আদায় করা হচ্ছে ।"
মালিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, "এমন অনেক আসামি থাকলে, তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে সঠিক তদন্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, যার ফলে প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যায়।"
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, "হাসিনার পতনের পর একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। তারা নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করছে এবং তারপর তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য টাকা দাবি করছে।"
এটি পূর্ববর্তী সরকারের দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিকতা হিসেবে বর্ণনা করে ইফতেখারুজ্জামান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানবাধিকার রক্ষার জন্য একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। "এমন অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে," তিনি জোর দিয়ে বলেন।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী-এর সাথে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও, তিনি সাড়া দেননি।
তবে ডিএমপি কমিশনার এসএম সাজ্জাদ আলী মিথ্যা মামলা এবং চাঁদাবাজির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং জানান, কিছু পুলিশ কর্মকর্তা এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত।
তিনি বলেন, "আমরা দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং সংশ্লিষ্ট থানার অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছি, মিথ্যা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করতে।"