সোনালী ব্যাংকের ৪০ বছর আগের ভুয়া মামলায় ভুক্তভোগীকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ
৪০ বছরের আইনি লড়াই শেষে ন্যায়বিচার পেয়েছেন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র। প্রমাণিত হয়েছে, চার দশক আগে তার বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা করেছিল সাবেক কর্মস্থল সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এই মামলায় হাইকোর্টের রায়ে জয়লাভ করেছিলেন হরেন্দ্রনাথ। পরে আপিল করে ব্যাংক। সেই আপিল সোমবার (৯ ডিসেম্বর) নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
একইসঙ্গে ভুয়া মামলা করে হয়রানি করার কারণে প্রবীণ হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রকে মামলা পরিচালনার খরচ হিসেবে ২০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ৩ মাসের মধ্যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এই টাকা পরিশোধ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
সোমবার আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে হরেন্দ্রনাথের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।
আইনজীবীরা বলেছেন, এটি আপিল বিভাগের একটি ঐতিহাসিক রায়। কারণ ভুয়া মামলার শিকার কেনো ভুক্তভোগী বাদীপক্ষের কাছ থেকে এরকম ক্ষতিপূরণ পেতে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের নজির বিরল। এরকম রায় বা আদেশ হলে ভুয়া মামলার পরিমান অনেকটাই কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র। জীবনের অর্ধেক সময়—৪০ বছর—কাটিয়েছেন আদালতের বারান্দায়।
৪০ বছর আগে ব্যাংকের ১৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে। তবে মামলায় খালাস পেলেও সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপিল করে মামলাটি জিইয়ে রাখে।
বিএ পাশ করে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক পদে সোনালী ব্যাংকে ঢাকার একটি শাখায় যোগদান করেন হরেন্দ্রনাথ। তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক হন। এরপর তাকে যাত্রাবাড়ী শাখায় বদলি করা হয়।
১৯৮৫ সালে রেমিট্যান্স-সংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে লোকাল অফিসে স্থানান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা সিল-স্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে সমুদয় অর্থ বুঝে নেন। কিন্তু এর কিছুদিন পর ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
তহবিল তছরুপের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে হরেন্দ্রসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে তাদের সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এরপর গ্রাহকের টাকা জমা না দেওয়ায় অপর একটি মামলায় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে স্থাপিত একটি আদালত হরেন্দ্রনাথকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি অন্যদেরও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে হরেন্দ্রনাথ জেল খেটে বের হন।
এর আগে ১৯৮৫ সালের জুলাইয়ে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকার বিশেষ আদালতে ফৌজদারি মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। বিচারে ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে বেকসুর খালাস পান হরেন্দ্রনাথসহ সবাই।
মামলায় পরাজিত হয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গোপনে ১৯৮৮ সালে হরেন্দ্রনাথসহ সবার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সেই মামলায় একতরফা রায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়ার আদেশ দেন আদালত।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন (মিস কেস) করেন হরেন্দ্রনাথ। ১৯৯২ সালের আগস্টে ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালত তার আপিল গ্রহণ করেন; একইসঙ্গে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন।
এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে। ২০২২ সালের আগস্টে ওই আপিল খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। গত বছর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সোমবার শুনানি শেষে লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ।