ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়ল মহাবিপন্ন মেঘলা চিতা
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দীর্ঘদিন ধরে বেঙ্গল টাইগার, এশীয় হাতি, গঙ্গা নদীর ডলফিন, মুখপোড়া হনুমান এবং হুলক উল্লুকসহ নানা বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন কয়েকজন প্রাণী বিশেষজ্ঞ এবং সংরক্ষকরা ক্যামেরা ট্র্যাপ ও বন্যপ্রাণী সেনসাসের মাধ্যমে এমন প্রাণীর উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন, যেগুলো অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি।
নতুন করে সন্ধান পাওয়া এসব প্রাণীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্লাউডেড লেপার্ড বা মেঘলা চিতা (Neofelis nebulosa), যেটি সাধারণত বাংলাদেশে গেছো বাঘ নামেই পরিচিত। সম্প্রতি ক্যামেরা ট্র্যাপ ফুটেজের মাধ্যমে প্রাণীটির উপস্থিতি ধরা পড়েছে।
মেঘলা চিতাবাঘ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে পাওয়া গেলেও, দ্রুত তাদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এই প্রজাতিকে বৈশ্বিকভাবে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মুনতাসির আকাশ বলেন, "২০২৩ সালে বাংলাদেশের পূর্বে ভালুক এবং ঢোলের বাস্তুতন্ত্র ও সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা করার সময় একটি মেঘলা চিতার ছবি ক্যামেরা ট্র্যাপে পাই। যদিও বাংলাদেশে এই প্রজাতির কোনো অফিসিয়াল রেকর্ড নেই, তবুও ২০০৬ সাল থেকে মেঘলা চিতা দেশের বিভিন্ন অংশে অল্পবিস্তর দেখা গেছে।"
আকাশ আরও জানান, গত ২০ বছর ধরে তিনি মেঘলা চিতার উপস্থিতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। তার মতে, ২০০৬ সালে জামালপুর, ২০০৯ সালে রাঙ্গামাটি, ২০১৪-২০১৫ সালে বান্দরবান, ২০১৮ সালে সাঙ্গু-মাতামুহরি বনাঞ্চল এবং ২০২১ সালে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের মতো স্থানগুলোতে মেঘলা চিতা দেখা গেছে।
মেঘলা চিতা আইইউসিএন ঘোষিত বাংলাদেশের ১৭টি মহাবিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে একটি। আকাশ বলেন, চট্টগ্রামের সাঙ্গু-মাতামুহরি বনাঞ্চলকে এই প্রজাতির জন্য একমাত্র নিরাপদ বাসস্থান বলে মনে করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র মেঘলা চিতা কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে রয়েছে। ২০২৩ সালে এটি রাঙ্গামাটি থেকে স্থানীয় জনগণ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় আটক করা হয়েছিল।
মেঘলা চিতা একটি অনন্য বন্য বিড়াল, যেটিকে বড় এবং ছোট বিড়ালের মধ্যে সংযোগকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি বড় দাঁত এবং ক্ষুদ্র দেহের কারণে পরিচিত। এই বিড়ালটি বনে ছোট প্রাণী যেমন বানর এবং ইঁদুর জাতীয় প্রাণী খেয়ে থাকে। এটি মানুষের প্রতি আক্রমণাত্মক নয়।
বাংলাদেশে বন্য বিড়ালের জন্য আরও সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রয়োজন
পূর্ববর্তী বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশের দুইটি বড় বিড়াল প্রজাতি– বেঙ্গল টাইগার (Panthera tigris tigris) এবং ভারতীয় চিতাবাঘ (Panthera pardus fusca) সংরক্ষণ প্রচেষ্টার ওপর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ চালানো হয়েছে।
বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা সম্পর্কে সরকারি সংরক্ষণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি আনুমানিক হিসাব তৈরি করা হয়েছে। তবে চিতাবাঘ এবং অন্যান্য বন্য বিড়ালের কোন আনুষ্ঠানিক তালিকা নেই, কারণ সেগুলো এখনও সংরক্ষণ উদ্যোগ বা ব্যাপক গবেষণার আওতায় আসেনি।
২০১৭ সালে একটি গবেষণায় কক্সবাজারের পাহাড়ি বনাঞ্চলে ভারতীয় চিতাবাঘের উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত চালানো জরিপে গবেষকরা একটি চিতাবাঘ সরাসরি দেখতে পান এবং শেখ জামাল ইনানি জাতীয় উদ্যানের তিনটি আলাদা স্থানে পাগমার্ক (পদচিহ্ন) রেকর্ড করেন।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, মানবসৃষ্ট কারণ যেমন অবৈধভাবে বনভূমি দখল, কাঠ ও জ্বালানির জন্য বনের অত্যধিক ব্যবহারের পাশাপাশি বন্যপ্রাণী শিকার চিতাবাঘের বাসস্থান সংকুচিত হওয়ার মূল কারণ।
অন্য গবেষণা বিশ্লেষণ এবং বাঘের সাথে বিরল সাক্ষাতের ভিত্তিতে মুনতাসির আকাশ বলেন, "চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের বনাঞ্চলে বন্য বিড়াল, বিশেষ করে মেঘলা চিতা থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি।" তিনি জানান, এই অঞ্চলটি ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামের সীমান্তবর্তী অংশের সাথে যুক্ত একটি বিস্তৃত বনভূমির অংশ।
মেঘলা চিতার সন্ধান পাওয়া কঠিন, কারণ প্রাণিগুলো নিশাচর এবং ঘন পাহাড়ি বনে বাস করে। স্থানীয়রা সাধারণত এগুলোকে দেখলে বিভ্রান্ত হয় এবং সেগুলোকে হত্যা করার চেষ্টা করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, স্থানীয়রা এগুলোকে অন্যান্য বিড়ালের মতো ভাবে এবং মানুষের জন্য বিপজ্জনক মনে করে।
তবে দুই প্রাণীবিজ্ঞানী মনে করেন, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বন্য বিড়ালের অল্পবিস্তর সন্ধান পাওয়ার মানে হলো, বনাঞ্চলটি প্রাণীগুলোর বসবাসের জন্য ভালো।
তারা জানান, সরকারের এবং অন্যান্য সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর উচিত এই প্রাণীর সঠিক অবস্থা নির্ধারণের জন্য গবেষণায় বিনিয়োগ করা। এতে করে আনুষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষণ কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়