ফিরল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, পঞ্চদশ সংশোধনীর কয়েকটি অনুচ্ছেদ অবৈধ
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তত ৫৪টি পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সেই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিটের শুনানি শেষে আজ মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল না হলেও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ সংশ্লিষ্ট ধারাসহ বেশ কয়েকটি বিধান বাতিল করেছেন। তবে বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পরবর্তী সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
রায়ে আদালত বলেছেন, সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
আবেদনকারীদের আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া জানান, সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ, মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন সংক্রান্ত ৪৪ (২), তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিধান এবং গণভোট বাতিল সংক্রান্ত ১৪২ অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণসহ এ সংক্রান্ত যেকোনো কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ৭খ অনুচ্ছেদে সংবিধানের মৌলিক বিধান সংশোধনকে সম্পূর্ণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের মাধ্যমে অন্য কোনো আদালতকে তার নিজস্ব এখতিয়ারের সীমার মধ্যে ওই ক্ষমতা প্রয়োগের অনুমতি দিতে পারবে।
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধানটি, যা ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিল, পঞ্চদশ সংশোধনী আইনে বিলুপ্ত করা হয়েছিল। আদালত মনে করেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই এই ধারা বাতিল করে ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধানও পুনর্বহাল করা হয়েছে।
রায়টিকে ঐতিহাসিক অভিহিত করে এ আইনজীবী বলেন, ৭-এর ক এবং খ , ৪৪ (২) ও ১৪২ অনুচ্ছেদ বিষয় আজকের রায়ের ফলে বাস্তবায়িত হয়ে গেল। তবে সংসদের মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হলো—সেটার প্রতিবন্ধকতা আজকে পার হলাম। তবে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে যে রায় (তত্ত্ববধায়ক অবৈধ) সেটার পুর্নবিবেচনা পরিবর্তিত হতে হবে ব্যবস্থাটা ফিরে আসার জন্য। সেটা জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে শুনানি হবে। যদি রিভিউ আমাদের পক্ষে আসে তাহলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরবে।
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন।
ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়।
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়।
আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়েরকৃত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট পিটিশন দায়ের করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চাওয়া হয়।
ওই রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, অন্যান্য সংস্থা ও ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন। শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা শুনানিতে স্ব স্ব বক্তব্য তুলে ধরেন।
গত অক্টোবরে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন একটি রিট আবেদন করেন। এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চাওয়া হয়। এ রুলের ওপরও শুনানি হয়।