দি ইকোনমিস্টের বর্ষসেরা দেশ বাংলাদেশ
২০২৪ সালের 'বর্ষসেরা' দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করেছে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য উন্নতির জন্য এই স্বীকৃতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
দি ইকোনমিস্ট প্রতি বছর এমন একটি দেশকে নির্বাচন করে, যে দেশ বিগত ১২ মাসে উন্নতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। এই পুরস্কারের জন্য দেশের সম্পদ, সুখ বা গুণগত মান নয়; বরং তাদের সামগ্রিক অগ্রগতি বিবেচনা করা হয়।
২০২৩ সালের বিজয়ী দেশ ছিল গ্রীস। দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশটি নিজেকে টেনে তুলতে সক্ষম হওয়ায় এবং একটি যুক্তিবাদী মধ্যপন্থী সরকারকে পুনর্নির্বাচিত করায় দেশটি সেরা দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়।
এর আগে কলম্বিয়া (গৃহযুদ্ধের অবসান), ইউক্রেন (রাশিয়ান আগ্রাসন প্রতিরোধ), এবং মালাউই (গণতন্ত্রায়ণ) এই পুরস্কার পেয়েছে।
এবছর বাংলাদেশের পাশাপাশি সেরা দেশের চূড়ান্ত তালিকায় ছিল আরও চারটি দেশ—সিরিয়া, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পোল্যান্ড। তবে শেষপর্যন্ত বর্ষসেরা দেশ নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ এবং দ্বিতীয় স্থান লাভ করে সিরিয়া।
বাংলাদেশকে বিজয়ী ঘোষণা করে দি ইকোনমিস্ট বলে, "আমাদের বিজয়ী দেশ বাংলাদেশ, যা একজন স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে। আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে ব্যাপক রাজপথ আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটির স্বাধীনতার মহানায়কের কন্যা শেখ হাসিনা এক সময় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতীক ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার শাসন দমনমূলক হয়ে ওঠে। নির্বাচনে কারচুপি, বিরোধীদের দমন, এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি, তার শাসনামলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে ।"
দি ইকোনমিস্টের ভাষ্যে, "ক্ষমতা পরিবর্তনের সময় প্রতিহিংসামূলক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাংলাদেশের। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে প্রায়ই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে বিবেচনা করা হয়। ইসলামী চরমপন্থাও দেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি। তবুও, এ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আশাব্যঞ্জক বলেই মনে হয়েছে।
বর্তমানে একটি অস্থায়ী সরকার দেশটির দায়িত্বে রয়েছে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকার ছাত্র, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এবং নাগরিক সমাজের সমর্থন নিয়ে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয়েছে।
২০২৫ সালে এই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণ করা। তবে এর আগে নিশ্চিত করতে হবে যে, আদালতগুলো নিরপেক্ষ রয়েছে এবং বিরোধী দলগুলোর সংগঠিত হওয়ার সময় আছে।
এই কাজগুলো সহজ হবে না। তবে একজন স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটিয়ে আরও উদারপন্থি সরকারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ ২০২৪ সালে 'বর্ষসেরা দেশ'-এর মর্যাদা অর্জন করেছে।"
বাংলাদেশের পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সিরিয়া। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার দীর্ঘকালীন শাসক বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করা হয়। আসাদের শাসনামল ছিল বর্বর ও দমনমূলক। তার সময়ে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আসাদের পতনের পর দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে। যদিও এই গোষ্ঠী পূর্বে আল-কায়েদার সাথে যুক্ত ছিল, তারা এখন তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী আচরণ করছে। তবে, ভবিষ্যতে দেশটি স্থিতিশীল থাকবে কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে আর্জেন্টিনা। দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলে বিশ্বের সবচেয়ে কট্টর মুক্তবাজার অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করেছেন। সরকারি খরচ কমানো এবং বাজার উদারীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতি তৃতীয় প্রান্তিকে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। তবে দেশটির মুদ্রার অতিমূল্যায়ন এবং সংস্কারের প্রতি জনসমর্থনের অভাব ভবিষ্যতের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানে ২০২৪ সালের নির্বাচনে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) প্রথমবারের মতো সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এএনসি এখন একটি জোট সরকার গঠন করেছে, যা দেশের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
পঞ্চম স্থানে রয়েছে পোল্যান্ড। দেশটির নতুন প্রশাসন ডোনাল্ড টাস্কের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও প্রতিবেশী জার্মানির সঙ্গে সম্পর্ক এখনো উত্তপ্ত, পোল্যান্ড ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন