রেলের ইঞ্জিন সংকট: ঈদ-উল-ফিতরের সময় পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা
বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিন সংকটের মধ্যে পণ্য পরিবহনের কনটেইনারবাহী ট্রেন চলাচলের পরিমাণ কমেছে।
আসন্ন ঈদুল ফিতরের সময়, অর্থাৎ চলতি বছরের এপ্রিল মাসের দিকে যাত্রীবাহী ট্রেনের প্রতি গুরত্ব দেওয়া হলে, এই সংকট আরও তীব্র হতে পরে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া, রমজান মাসে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ইবাদতের জন্য কর্মঘণ্টা শিথিল করা হয়। এসব কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের ডিপোতে পণ্যবাহী কনটেইনারের স্তূপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চাহিদার তুলনায় কম কনটেইনারবাহী ট্রেন চলাচল করছে। আগের চেয়ে ট্রেনের সংখ্যা কমেছে। ডিপোতে মোট ৮০০ কনটেইনার রাখার সক্ষমতা আছে। কিন্তু বর্তমানে জমে আছে প্রায় ১৪০০ কনটেইনার। ফলে আমদানি ও রপ্তানিকারকদের পরিবহন ব্যয় বাড়ছে।"
তিনি বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বিষয়টি নিয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলছেন, রোলিং স্টকের সংকট নিরসন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।"
চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) এর তথ্যমতে, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে মোট ২৭টি কনটেইনারবাহী ট্রেন চট্টগ্রাম ডিপো থেকে ঢাকা আইসিডির (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো) উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। গড়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুটি কনটেইনারবাহী ট্রেন চলছে। কোনো কোনো দিন একটিও চলছে। অথচ এক বছর আগেও এই রুটে তিন থেকে চারটি কনটেইনারবাহী ট্রেন চলাচল করতো। ইঞ্জিন ও লোকবল সংকটের কারণে ট্রেনের সংখ্যা দিন দিন কমছে।
সিজিপিওয়াই থেকে জ্বালানি তেল, পাথর, খাদ্যশস্য, শিল্প কাঁচামালের জন্য মোট ১৫টি ইঞ্জিনের (লোকোমোটিভ) চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে মাত্র ৭টি ইঞ্জিন পায় নিয়মিত। শুধু কনটেইনারবাহী ট্রেনের জন্য ৭টি ইঞ্জিনের চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে ২টি পাচ্ছে সিজিপিওয়াই।
চট্টগ্রাম ডিপো থেকে ঢাকা আইসিডিতে কনটেইনারবাহী ট্রেন ৪৫ কিলোমিটার বেগে চলে। ফলে ১৮-২২ ঘণ্টা সময় লাগে পৌঁছাতে। প্রতিটি ট্রেনে ৪০ ফুটের ৩২টি কনটেইনার বা ২০ ফুটের ৬৪টি কনটেইনার বহন করার সুযোগ রয়েছে। ট্রেনের সংখ্যা কমায় পণ্যবাহী কনটেইনার সিরিয়াল পেতে এক সপ্তাহ লাগে। অথচ আগে সিরিয়াল পেতে দুদিন সময় লাগত।
বাংলাদেশের কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি। তারা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কথা বলছে। রেল কর্তৃপক্ষকেও বলেছি। কিন্তু সমস্যা সমাধান হচ্ছে না।"
"চাহিদামতো ট্রেন না চলায় ধীরগতির কারণে অতিরিক্ত পোর্ট চার্জ বহন করতে হয় আমদানি-রপ্তানিকারকদের। এছাড়া ঠিক সময়ে পণ্য পরিবহন করা যায় না। রমজানে সংকট আরও বাড়বে। এর আগে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে," যোগ করেন তিনি।
রেলওয়ের পরিবহন ও যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, সবকটি ট্রেন চালাতে প্রয়োজন ৩ হাজারের বেশি কোচ এবং প্রায় ৫০০ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। কিন্তু রেলে বর্তমানে মোট আড়াই হাজারেরও বেশি কোচ আছে এবং তিন শতাধিক ইঞ্জিন।
তবে এসব ইঞ্জিন ও কোচের মধ্যে সব সচল নয়। ৫০ শতাংশের বেশি ইঞ্জিন ও কোচের আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে। বর্তমানে সচল কোচের সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি এবং সচল ইঞ্জিন আছে মাত্র দুই শতাধিক।
এরমধ্যে সিজিপিওয়াই হলো পূর্বাঞ্চলের অধীনে, যার ১,১৩১টি কোচ ও ৭৬টি ইঞ্জিন সচল। পূর্বাঞ্চলের বন্ধ ট্রেনসহ সবকটি ট্রেন চালাতে নূন্যতম ১১৬টি ইঞ্জিন ও ১,৫০০ কোচ দরকার।
রেলওয়ের তথ্যমতে, গত এক যুগে রেলওয়ের উন্নয়নে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এরমধ্যে রেললাইন, সেতু, ভবন নির্মাণ এবং ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
গত এক দশকের রেলের বহরে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৮০০ কোচ এবং মাত্র ৩০টি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। যথাযথ পরীক্ষা না করে কেনায় ভারী এসব ইঞ্জিন পুরনো রেল সেতুগুলোতে চলতে পারে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহার করা যাচ্ছে না ইঞ্জিনগুলো।
নতুন করে আরো ৩০০টি ইঞ্জিন আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও তাতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে।
রেলপথ নির্মাণ করা হলেও ইঞ্জিন, কোচ আমদানি না করার কারণে চাহিদা অনুযায়ী ট্রেন চালাতে পারছে না রেলওয়ে। ফলে এ খাতে বছরে ২,০০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হয় সরকারকে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের (চট্টগ্রাম) বিভাগীয় ট্রাফিক কর্মকর্তা মো: আনিসুর রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রমজানে সিজিপিওয়াই এর ট্রেন চলাচল নিয়ে সংকট আরো তীব্র হবে। ইঞ্জিন ও লোকবল সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত জানানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি।"