টেলিটকের ফোর-জি সেবাই ঠিকমতো পাওয়া যায় না, এখন শুরু ফাইভ-জি’র ট্রায়াল
রোববার (১২ ডিসেম্বর) ট্রায়াল ভিত্তিতে ছয়টি সাইটে ফাইভ-জি পরিষেবা চালু করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল সেবাদাতা কোম্পানি টেলিটক। ফাইভ-জি'র যুগে প্রবেশ একটি ভালো খবর হলেও, বাস্তবতা আলাদা।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক ওয়্যারলেস মোবাইল প্রযুক্তিতে বিপ্লব আনবে। ব্যবহারকারীদেরকে তাদের ডিভাইস এবং যন্ত্রের সঙ্গে আগের চেয়ে আরও ভালভাবে যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেয় এই সেবা।
নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশকে ডিজিটালাইজ করা এবং দেশের ক্রমবর্ধমান মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সেক্টর ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন বিকাশের পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষার সুযোগকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ এটি।
তবে, এসব দৃশ্যমান সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের যে প্রশ্নটি করা উচিত তা হলো, ফাইভ-জি প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার মতো ক্ষমতা কি আসলেই আমাদের আছে?
এছাড়াও আরেকটি প্রশ্ন হল, কেনই বা টেলিটক ফাইভ-জি'র ট্রায়াল চালাচ্ছে? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিটি পূর্বে গ্রাহকদেরকে ফোর-জি পরিষেবা দিতে ব্যর্থ হলেও কেন এমন একটি পরিষেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে যেটির সাফল্যের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা
টেলিকম খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ফাইভ-জি প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। লার্নেশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, "ফাইভ-জি অবকাঠামোর মৌলিক উপাদান হলো একটি সর্বব্যাপী অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক। আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা নেই।"
অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য ফাইভ-জি প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। টেলিকম এবং আইসিটি খাতের এই বিশেষজ্ঞের মতে, দেশে অটোমেশনের বিস্তৃত সুযোগ থাকলেও নেটওয়ার্ক পরিষেবাগুলোকে সেসবের জন্য উপযুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ, নেটওয়ার্ক শিল্পকেও একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
সাঈদ খান আরও বলেন, আমাদের কাছে ফাইভ-জি পরিষেবা চালানোর মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশনের সুযোগ রয়েছে।
"আমরা যদি টেক্সটাইল বা গার্মেন্টসের মতো শিল্পগুলোর দিকে তাকাই, তবে এর পরিধি বিস্তৃত। আমাদের চট্টগ্রাম এবং মোংলায় যে দুটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে, দুটিতেই কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এবং ক্লিয়ারেন্সের কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যেতে পারে," তিনি বলেন।
"কিন্তু স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রম চালানোর জন্য সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন কোম্পানিগুলোর," যোগ করেন তিনি।
টেলিকম কোম্পানিগুলোকে ফাইভ-জি সেবা চালাতে বাধা দেওয়ার জন্য কেবল পরিকাঠামোগত সমস্যা নয়, রয়েছে নিয়ম-নীতি নির্ভর সমস্যাও।
"উদাহরণস্বরূপ, আপনি একটি রেস্তোরাঁ চালু করতে চাইলে আপনাকে একটি ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে। কিন্তু সরকার যদি আপনাকে মেন্যুতে থাকা প্রতিটি আইটেমের জন্য লাইসেন্স করতে বাধ্য করে, তাহলে সেটি সমস্যার," সাঈদ খান বলেন।
টেলিকম শিল্পে এ ধরণের সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং এর সমাধান করতে হবে। তার মতে, মোবাইল ফোন অপারেটরদের ফাইভ-জি প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো চালু করার স্বাধীনতা থাকা দরকার। তাদের এই সুবিধা ভাগ করে নেওয়া উচিত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের নকল করার কোনো মানে নেই। গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি-তাদেরও এটি শেয়ার করা উচিত," যোগ করেন তিনি।
ফাইভ-জি প্রযুক্তির অর্থ হল ব্যাপক পরিকাঠামোগত পরিবর্তন। ক্লাউড কম্পিউটিং থেকে শুরু করে এইচ কম্পিউটিং এবং এগুলো ছাড়াও অনেক কিছুই। তবে, বাস্তবে এই ক্ষেত্রে ব্যাপক অভাব দেখা যায়। এমনকি এই বিষয়ক আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় নীতির অভাব রয়েছে বলেও জানান সাঈদ খান।
"টেলিটকের ফাইভ-জি সেবা চালু আসলে সরকারের পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক স্টান্ট। একটি টেলিকম কোম্পানি পরিচালিত এবং রাজনৈতিকভাবে চালিত প্রযুক্তিগত পরিষেবাকে মহিমান্বিত করার একটি উপায় এটি। কিন্তু বাস্তবে ফোর-জি সেবা দিতেই ব্যর্থ তারা।"
তবে, এ বিষয়ে ফাইবার অ্যাট হোম লিমিটেডের চিফ টেকনোলজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির বেশ আশাবাদী। তিনি বলেন, "আমাদের পঞ্চম জেনারেশনের নেটওয়ার্কে যাওয়া অনিবার্য। এই উদ্যোগে বিনিয়োগের অভাব থাকলেও ভবিষ্যতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং পরিষেবা সহায়তা বাড়লে আমরা দেশে এই প্রযুক্তি চালাতে সক্ষম হব।"
এমনকি প্রশ্ন উঠেছে টেলিটকের পরীক্ষামূলক পরিষেবার কেন্দ্রগুলো নিয়েও। টুঙ্গিপাড়া, জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ, বাংলাদেশ সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ধানমন্ডি-১৩, এবং শেরেবাংলা নগরে চালু হবে এ সেবা।
সাঈদ খান বলেন, "টুঙ্গিপাড়া এবং নির্বাচিত অন্যান্য টার্গেট সাইটগুলোতে ফাইভ-জি প্রযুক্তির কোনো প্রয়োগ নেই।"
বিটিআরসির ভাইস-প্রেসিডেন্ট সুব্রত কুমার রায় বলেন, "স্থান নির্বাচনের পেছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই। আমরা এর সম্ভাব্যতা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছি যার সামগ্রিক ফলাফল বেশ ইতিবাচক। এই পরীক্ষা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।"
তার মতে, টেস্ট রান চালু করার এই উদ্যোগটি দেশে ফাইভ-জি প্রযুক্তি আনার বিষয়ে সরকারের অভিপ্রায়ের প্রমাণ।
"আমরা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় নামতে চাই এবং এই পদক্ষেপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ," বলেন তিনি।
কিন্তু মূল সমস্যাগুলো এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সরকারকে অ্যান্টি-ব্রডব্যান্ড অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনার নীতি পরিশোধন করতে হবে; সেটি ফাইভ-জি বা ফোর-জি যেই প্রযুক্তিই হোক না কেনো। অন্যথায়, এসব প্রচেষ্টা কেবল ব্যর্থই হবে।
- মূল প্রতিবেদন: Teletalk 5G trial run is here. But what does that really mean?
- ভাষান্তর: সাদিয়া আফরিন শায়লা