আমেরিকায় পরীক্ষা করা সার্চলাইট বাংলাদেশে এসে হয়ে গেল ফগ লাইট!
ঘন কুয়াশার মধ্যে নির্বিঘ্নে ফেরি চলাচলের জন্য ৬ কোটি টাকা খরচ করে ১০টি ফগ লাইট কেনার আগে তা পরীক্ষা করা হয়েছিল গ্রীষ্মকালের দিনের বেলায়।
২০১৫ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির আকাশে যখন ঝলমলে রোদের খেলা, সেইসময় ওই লাইট প্রজ্জলন করে, তা বাংলাদেশের মাওয়া-আরিচার নদীরুটে ঘন কুয়াশার সময় ব্যবহারযোগ্য কি না, সেই পরীক্ষাই করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) চার কর্মকর্তা।
বিআইডব্লিউটিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান, প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল, জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত আলী সরদার (ডিরেক্টর অপারেশন) এবং ডেপুটি সেক্রেটারি পঙ্কজ দেবনাথ এই পরীক্ষাকাজে অংশ নেন।
বিআইডব্লিউটিসির বিরুদ্ধে অন্য বিষয়ে একটি রিট মামলায় এই বিষয়টি আবিষ্কার করেছে হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত রায়ে আদালত বিস্ময় প্রকাশ করেছে এই পরীক্ষার সময় নিয়ে।
হাইকোর্ট রায়ে ইঙ্গিতি দিয়ে বলেছেন, এই ফগ লাইট কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হল গ্রীষ্মকালের দিনের বেলায় এই পরীক্ষা।
সম্প্রতি বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী এবং বিচারপতি কাজী জিনাত হকের স্বাক্ষর করা পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন আদালত।
১০টি ফগলাইট কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতা পেলেও এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
বিআইডব্লিউটিসির একটি সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, এই ফগ লাইটগুলো এখনো অকার্যকরভাবে স্থাপিত রয়েছে মাওয়া আরিচা রুটের বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, শাহ্ আমানত, কেরামত আলী এবং শাহ্ পরান ফেরিতে। ফলে ঘনকুয়াশায় এখনো এসব ফেরি চলাচল করতে পারে না।
চার কর্মকর্তার মধ্যে তৎকালীন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কিছুদিন আগে মারা গেছেন। প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল ২০১৭ সালে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান হওয়ার পর অবসরে গেছেন। ক্যাপ্টেন শওকত আলী সরদার (ডিরেক্টর অপারেশন) পিআরএলে রয়েছেন। ডেপুটি সেক্রেটারি পঙ্কজ দেবনাথ অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে রয়েছেন।
হাইকোর্ট রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, "এটি রেকর্ডে রয়েছে যে জুন মাসে ফগ লাইট পরীক্ষা করা হয়েছিল। গ্রীষ্মকালে যখন একেবারে কুয়াশা কুয়াশা থাকে না তখন কীভাবে ফগ লাইট পরীক্ষা করা যেতে পারে তা অকল্পনীয়। এটি কেবল সাধারণ জ্ঞান এবং যুক্তির পরিপন্থী নয়, বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের সম্পূর্ণ বেপরোয়া আচরণও প্রদর্শন করে। তা সত্ত্বেও, পরিদর্শন করার পরে, কর্মকর্তারা প্রত্যয়িত করেছেন যে ফগ লাইটগুলি 'ওয়ার্কিং অর্ডারে' ছিল। যাইহোক, শীত শুরু হওয়ার পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট হয়, ফগ লাইটগুলি একেবারেই অকার্যকর ছিল। এতে ফেরি সার্ভিস মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শত শত যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্নবিদ্ধ ফগ লাইট সংগ্রহের জন্য ছয় কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এই সত্যটি উল্লেখ করা প্রসঙ্গের বাইরে নাও হতে পারে।"
বিআইডব্লিউটিসির এই চার কর্মকর্তা ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে এই ফগ লাইট পরীক্ষার জন্য গেলেও তারা মূলত প্রমোদ ভ্রমণ করেছেন সেখানে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা লাইট পরীক্ষার জন্য কাজ করেছেন তারা।
কেচো খুঁড়তে গিয়ে বের হল সাপ
এই দশটি ফগ লাইট যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর নাগাদ দেশে আনার পর স্থাপন করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, শাহ্ আমানত, কেরামত আলী এবং শাহ্ পরান ফেরিতে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ঘন কুয়াশার সময় এই ফগলাইটগুলোর অকার্যকর বলে ধরা পড়ে।
বিআইডব্লিউটিসি এই অকার্যকর লাইটের দায় চাপিয়ে দেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান 'জনি কর্পোরেশন' এর ওপর। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে লাইটগুলো সরবরাহের অগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বিআইডব্লিউটিসির চার কর্মকর্তা লাইটের সকল কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে।
পরবর্তীতে বিআইডব্লিউটিসি 'জনি কর্পোরেশন' এর দেওয়া ২৮ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির নগদ টাকা চেয়ে নোটিশ দেয়। এরপর ওই নোটিশের বৈধতা চ্যলেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে 'জনি কর্পোরেশন' এর স্বত্বাধিকারী ওমর আলী। হাইকোর্ট ওই নোটিশের কার্যকরিতা স্থগিত করে এই এবং ওই ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা নিয়ে রুল জারি করে বিআইডব্লিউটিসির প্রতি।
ওমর আলী'র আইনজীবী বাহাদুর শাহ্ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই রুল শুনানির এক পর্যায়ে ২০১৭ সালে হাইকোর্ত এই ফগ লাইটগুলোর কেনার বিষয়ে টেন্ডার থেকে শুরু করে বর্তমান অবস্থার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন চান বিআইডব্লিউটিসির কাছে। ওই প্রতিবেদনগুলো যাচাই বাছাই করে হাইকোর্ট গ্রীষ্মকালে লাইট পরীক্ষা ও কারগরি জ্ঞানহীন কর্মকর্তাদের বিষয়টি আবিষ্কার করে। যা আদালত পূর্ণাঙ্গ রায়ে তুলে ধরেছেন।
তবে চূড়ান্ত রায়টি ওমর আলীর বিরুদ্ধে যায়। যার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হয়েছে বলে জানান আইনজীবী।
ফগ লাইট না, এগুলো সার্চলাইট ছিল
২০১৬ সালে এই ফগ লাইটগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পর বিআইডব্লিউটিসি পরীক্ষা করে দেখতে পায় এগুলো ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজে ব্যবহারের জন্য সার্চ লাইট। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই লাইটগুলোর প্রতিটি ছিল ৭০০০ কিলো ওয়াটের। বিআইডব্লিউটিসি হাইকোর্টে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেলি, সেখানে এই বিষয় তুলে ধরা হয়।
জনি কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারী ওমর আলী টিবিএসকে বলেন, "জনি কর্পোরেশন ফার্মটি ব্যবহার করে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ছোট ভাই আজিজুর রহমান খান এই লাইটগুলো কেনার টেন্ডার নেয়।"
ওমর আলী বলেন, ৭০০০ কিলোওয়াটের প্রতিটি লাইটের দাম ছিল প্রায় ৫৩ লাখ টাকা করে। বাকি ৩০ লাখ টাকা চার কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র ভিজিট এবং অন্যান্য খরচের জন্য খরচ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, "এই লাইটগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার আগেই চার কর্মকর্তাকে জানানো হয়, এটি মূলত ফগ লাইট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজে ব্যবহারের জন্য 'সার্চ ফগলাইট'। যা হাফ কিলোমিটার পর্যন্ত আলো বিস্তার করে জাহাজকে পথ দেখাতে সাহায্য করে। আমি এই লাইট কেনার জন্য অর্ডার ডিনাই করি। এরপরও এগুলো ক্রয় করা হয়।"
বিআইডব্লিউটিসিরি একটি সূত্র জানায়, এই লাইটগুলোর যে দাম দেখানো হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম দামে কেনা হয়েছে। এটি মূলত তৎকালীন মন্ত্রীর ছোট ভাইয়ের প্রভাবে কেনা হয়।
আজিজুর রহমান খানের সাথে টিবিএসরে পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আরেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এই রায়ে
এই চার কর্মকর্তা বিদেশ সফরের নামে যে জনগণের ট্যাক্সের টাকা অপচয় করেছেন, সেই বিষয়টি রায়ে তুলে ধরেছেন আদালত। রায়ে আদালত সরকারের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরির নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, "আমরা বিদেশ ভ্রমণ করা সমস্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনার জন্য কিছু গাইডলাইন রাখার প্রস্তাব করছি। তবে, নির্দেশিকাগুলি কেবলমাত্র সরকারি সফরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত, সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো ব্যক্তিগত বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে নয়।"
রায়ে আরও বলা হয়, "অতিরিক্ত সচিব এবং নীচের পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাইরে সমস্ত অফিসিয়াল ভ্রমণের জন্য, শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই নয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও পূর্বানুমতি নিতে হবে। উপরে উল্লিখিত প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বানুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে কোনো সরকারি সফরে যেতে দেওয়া হবে না। আমাদের বিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গিতে, সরকারি কর্মকর্তাদের কল্পিত এবং উদ্দেশ্যহীন বিদেশ ভ্রমণ রোধ করার জন্য এবং করদাতাদের অর্থের অপচয় রোধ করার জন্য এটি প্রয়োজনীয়।"