ফিরে দেখা ২০২১: রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলা ও একটি বিচারিক ব্যর্থতা
২০২১ সালের সবচেয়ে আলোচিত একটি ঘটনা রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার রায়। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা দীর্ঘ-ক্লান্তিকর আইনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারতো এ মামলার নামও। কিন্তু তার বদলে বিতর্কিত রায় দেওয়ার মাধ্যমে দেশের বিচারব্যবস্থাকে আরও একবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে ২০১৭ সালের রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলা।
গত ১১ নভেম্বর বহুল আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত ৫ জনকেই বেকসুর খালাস দিয়েছে ঢাকার একটি ট্রাইবুনাল। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই নারী শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল তাদের উপরে।
মামলার পর্যবেক্ষণে ট্রাইবুনাল বলে, ধর্ষণের ৭২ ঘন্টা পর কোনো মামলা নেওয়া উচিত নয় পুলিশের।
বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার বলেন, "ডিএনএ পরীক্ষা ও অন্যান্য প্রমাণ না মেলায় প্রসিকিউশন ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। ভুক্তভোগীরা স্বেচ্ছায় সেদিন হোটেলে গিয়েছিলেন এবং সুইমিং করেছেন। ঘটনার ৩৮ দিন পর এসে তারা (দুই ছাত্রী) বললেন 'আমাদের ধর্ষণ করা হয়েছে'। এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করতে ৯৩ কর্মদিবস প্রয়োজন হয়েছে এবং এতে রাষ্ট্রের অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।"
তিনি আরও যোগ করেন, আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে ও মামলার অভিযুক্ত আসামীদের একজন, শাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াশার প্ররোচনায় ভুক্তভোগীরা এ মামলা দায়ের করেছেন।
রায়ে আদালত এও বলেন, অভিযুক্ত যে চারজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন, তাদেরকে আদালতে নিয়ে আসার আগে নির্যাতন করা হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের কারণে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং এ মর্মে একটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে।
রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনার ৩৮ দিন পর বনানী থানায় এই ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়।
দেশজুড়ে নারীদের উপর যৌন সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন অধিকার কর্মীরা। এরই মধ্য দিয়ে আদালতের এ রায়কে অদ্ভুত, অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর বলে আখ্যা দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
বিতর্কিত এ রায়ের তিন দিনের মাথায়, গত ১৪ নভেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাকে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ রায়কে লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেন এবং জানান, রায়ের এমন পর্যবেক্ষণ দেওয়ার ব্যাখ্যা চেয়ে কামরুন্নাহারকে শো-কজ নোটিশ পাঠানো হবে।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, শুধুমাত্র আইন দিয়ে বাংলাদেশের একজন নাগরিক বা দেশে অস্থায়ীভাবে বসবাসরত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে বা পক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারক তার বক্তব্যের মাধ্যমে আইন ও সংবিধান দুটোই লঙ্ঘন করেছেন।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে বিচারক কামরুন্নাহারের সই করা রায়ের লিখিত কপিতে ৭২ ঘন্টা পর ধর্ষণের অভিযোগ না নেওয়ার কথাটি উল্লেখ নেই।
৪৯ পৃষ্ঠার ওই লিখিত রায়ের একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসে পৌঁছালে দেখা যায়, রায়ে মেডিকেল রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, 'ভুক্তভোগীদের আগে থেকেই যৌন মিলনের অভিজ্ঞতা ছিল'। কিন্তু এ ধরনের ফরেনসিক পর্যবেক্ষণকে ভুক্তভোগীদের প্রতি অসম্মানজনক বলে অভিহিত করে ২০১৮ সাল থেকেই তা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাইকোর্ট।
২০১৮ সালে ধর্ষণ মামলা নেওয়ার বিষয়ে বেশকিছু নতুন গাইডলাইন যুক্ত করে আদালত। একজন সমাজকর্মীর উপস্থিতিতে ভুক্তভোগীর জবানবন্দী নেওয়া, থানায় ধর্ষণের অভিযোগ নিতে নারী কর্মকর্তা্দের দায়িত্ব দেওয়া, অক্ষম ভুক্তভোগীদের সাহায্য করাসহ একাধিক নিয়ম এ গাইডলাইনের আওতায় রয়েছে।
কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এসব গাইডলাইন মানা হয় এবং ধর্ষণ মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসি করার মাত্রাও কমেনি।
দেশে যৌন সহিংসতা বৃদ্ধি ঠেকাতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আইন মন্ত্রণালয়কে ৩০ দিনের মধ্যে একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
এরপর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সেই কমিশনের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, যৌন হয়রানি রোধ ও সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে সরকার যে আইন প্রণয়ন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারও কোনো কূলকিনারা হয়নি।
প্রতিনিয়তই সমাজে নানা রকম হয়রানি ও কটূক্তির শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। প্রয়োজনের সময় যথেষ্ট মানসিক সাহায্য বা সেবাও পাচ্ছেন না তারা।
ধর্ষণ মামলার রায়ে নিন্দা জানানোর পাশাপাশি ১৮৭২ সালের প্রমাণ আইনের ১৫৫ ধারা (৪) বাতিলের দাবি জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ আইন অনুযায়ী, একজন অভিযুক্ত আসামী ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা রাখে।
রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার বিবৃতি অনুযায়ী, ঘটনার দিন সাফাত আহমেদের জন্মদিনের পার্টিতে যোগ দিতে রেইনট্রি হোটেলে যান দুই নারী।
মামলায় অভিযুক্তরা হলেন, আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনের ছেলে শাফাত আহমেদ, সাফাতের বন্ধু এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ই-মেকারস এর কর্মকর্তা নাঈম আশরাফ ওরফে আবদুল হালিম, রেগনাম গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং ঢাকার পিকাসো রেস্টুরেন্টের মালিক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে সাদমান সাফিক এবং সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাস হোসেন এবং বডিগার্ড রহমত আলি।
অভিযুক্তরা দুই নারীকে অস্ত্রের মুখে ভয়ভীতি দেখিয়ে আলাদা দুই কক্ষে নিয়ে যায় এবং ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত হোটেল কক্ষে আটকে রাখে।
ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্টে বলা হয়, ভুক্তভোগী নারীকে সাফাত আহমেদ এবং তার বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ ধর্ষণ করেন এবং অন্য বন্ধুরা তাদের সহায়তা করেন।
২০১৭ সালের মে মাসে মামলা দায়েরের পর একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয় এবং ৩ জুন ভুক্তভোগীদের ফরেনসিক রিপোর্ট পুলিশের কাছে জমা দেওয়া হয়।
২০১৭ সালের ৮ জুন মামলায় অভিযুক্ত ৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ এবং ১৩ জুলাই তাদেরকে আইনত অভিযুক্ত করা হয়।