যুগোপযোগী পরিকল্পনার অভাব, পুরানো ৭ সেতু নিয়ে বিপাকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল
দীর্ঘদিন পর গত দেড় বছরে রেলের বহরে ৩০টি নতুন ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও বেশ কিছু ইঞ্জিন আমদানি করবে রেলওয়ে। কিন্তু অত্যাধুনিক এসব ইঞ্জিনের ভার বহনে সক্ষম নয় পূর্বাঞ্চল রেলের ৭টি সেতু। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এসব সেতুতে নতুন ইঞ্জিন চলাচলের বিষয়টি না ভেবে আমদানি শুরু হওয়ায় বিপাকে পড়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
২০১১ সালের পর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১০টি নতুন লোকোমোটিভ আমদানি করা হয়। ২০২০ সালে আমদানি হওয়া ইঞ্জিনগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার না হয়েই পড়ে ছিল রেলওয়ের ওয়ার্কশপে। বর্তমানে এসব ইঞ্জিন দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু রুটে সার্ভিস পরিচালনা করা হচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসে আরও ১০টি ইঞ্জিন আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। চলতি মাসের (জানুয়ারি) মধ্যে বাকি ১০টি ইঞ্জিনও দেশে চলে আসবে।
রেলের মেকানিক্যাল বিভাগ বলছে, পূর্বের সবচেয়ে ভারী ইঞ্জিনগুলোর গড় ওজন প্রতি এক্সেলে ১১ দশমিক ৯৬ লোডের হিসাবে (প্রতিটি ইঞ্জিনে ৬ এক্সেল) ৭০ থেকে ৭২ টন। বর্তমানে আমদানি হওয়া ও আমদানির প্রক্রিয়ায় থাকা ইঞ্জিনগুলোর গড় ওজন ১০০ টনেরও বেশি (প্রতি এক্সেলে ১৫ থেকে ১৬ টন)। সর্বশেষ প্রযুক্তির ইঞ্জিন হওয়ায় এসব ইঞ্জিন এক্সেল লোডের হিসাব থেকেও ভারী হয়। যার কারণে আমদানি হওয়া নতুন ইঞ্জিনগুলো প্রায় শতবর্ষী সেতুগুলো দিয়ে পারাপারের সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি অতিমাত্রায় বেড়ে যাবে। এতে রেলের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি হতাহতের আশঙ্কাও প্রবল বলে মনে করছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, গুরুত্বপূর্ণ ৭টি সেতু নিয়ে সবচেয়ে চিন্তিত রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। প্রায় শতবছরের পুরনো ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এসব সেতু দিয়ে বর্তমানে ১১ দশমিক ৯৬ টন এক্সেল লোড বিশিষ্ট লোকোমোটিভ/কোচ নিয়ন্ত্রিত গতিসীমায় চলাচল করে। কিন্তু বর্তমানে আমদানি হওয়া লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনগুলো ১৫ থেকে ১৬ টন এক্সেল লোডের। বিদ্যমান পুরনো ইঞ্জিনের তুলনায় এক্সেল প্রতি লোডের পরিমাণ ৩ থেকে ৪ টন বেশি হওয়ায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সেতুগুলোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দেয়া নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেতুগুলো হচ্ছে কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু, ভৈরব পুরাতন সেতু, কুশিয়ারা সেতু, ঘোড়াশাল (আপ) সেতু, শম্ভুগঞ্জ সেতু, ঘুমঘাট সেতু এবং ছাতক-সিলেট রুটের ২৮ নং সেতু। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৯ জুন এসব জীর্ণ সেতু দিয়ে নতুন আমদানি হওয়া ও আমদানিতব্য ভারী ইঞ্জিন চলাচল করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে বুয়েটকে পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ দিতে মহাপরিচালকের অনুমোদন চায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগ। তাছাড়া বিশেষ প্রকল্প হিসাবে দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য কর্ণফুলি নদীর উপর কালুরঘাট সেতুর স্থলে নতুন সেতু নির্মাণের আগে ট্রেন চলাচল নিরাপদ করতেও বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিচ্ছে রেলওয়ে। রেলভবনের অনুমোদনের প্রেক্ষিতে সর্বশেষ ২১ জুন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলকে কালুরঘাট সেতুর ভারবহনে সক্ষমতা নির্ণয় ও মেরামতে আর্থিক ও কারিগরি প্রস্তাবনা দিতে চিঠি দেয় পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আহসান জাবির।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ অক্টোবর বুয়েটের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম কালুরঘাট সেতু সরেজমিনে পরির্দশন করেছেন। পরির্দশন টিমে ছিলেন প্রফেসর ড. এ এফ এম সাইফুল আমিন, প্রফেসর ড. আবদুল জব্বার খান ও প্রফেসর ড. খান মাহমুদ আমানত। বুয়েট প্রতিনিধিদলের সাথে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আহসান জাবিরও উপস্থিত ছিলেন।
সেতুগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামত কিংবা নতুন সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে বলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে বেশি এক্সেল লোডের ইঞ্জিন চলাচলের কারিগরি উপযুক্ততা যাচাইয়ে বুয়েটের বিআরটিসি বিভাগকে সরাসরি নিয়োগ পদ্ধতিতে পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ দিতে প্রস্তাব করা হয়। সম্প্রতি প্রকৌশল বিভাগের এই প্রস্তাব অনুমোদন করে রেলপথ বিভাগ।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম থেকে ১০টি লোকোমোটিভ আমদানি করে রেলওয়ে। একই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গত ডিসেম্বরে আরও ১০ ইঞ্জিন আমদানি করে রেলওয়ে। চলতি মাসে আরো ১০টি ইঞ্জিন দেশে পৌঁছলে দীর্ঘদিনের পুরনো একাধিক ইঞ্জিন বাতিল করা হবে। ফলে আমদানিকৃত ৩০টি ইঞ্জিন পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চালানো হবে। কিন্তু ৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ রেল সেতুর কারণে নতুন লোকোমোটিভগুলো পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচল করা সম্ভব হবে না। বাধ্য হয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব সেতুকে ভারি ইঞ্জিন বহনে সক্ষম করতে বড় একটি প্রকল্প নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে রেলের। পরামর্শক দলের দেয়া প্রতিবেদন ও বাজেট বিবেচনায় এনে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে চায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলের সেতু বিভাগ বলছে, দীর্ঘমেয়াদে ভারী ইঞ্জিন ও কোচ চলাচলের জন্য দীর্ঘদিনের পুরনো সেতুর স্থলে নতুন সেতু নির্মাণ সবচেয়ে ভালো। কিন্তু রেলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলমান থাকায় এখনো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। আবার বেশ কিছু সেতু নির্মাণের প্রকল্পই শুরু করতে পারেনি। যার কারণে নতুন ইঞ্জিন দিয়ে রেলওয়ে সার্ভিস পরিচালনা করতে হলে যে কোনোভাবেই পুরনো সেতুগুলো বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে ইঞ্জিন সংকট দূর হলেও সেতুর কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভালোমানের ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন সার্ভিস পরিচালনায় নতুন বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হবে রেলওয়েকে।
জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন বলেন, "রেলে দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন সংকট ছিল। বর্তমানে রেলওয়ে সংকট দূর করতে ইঞ্জিন আমদানি শুরু করেছে। সুদূর প্রসারী চিন্তার অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে ভৈরব সেতু সহ বেশ কয়েকটি পুরনো সেতুর স্থলে নতুন সেতু নির্মাণও করেছে। কিন্তু কয়েকটি সেতু নির্মাণ পরিকল্পনাধীন থাকায় নতুন আমদানি হওয়া ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চলাচলে আপাতত সংস্কার কাজ করা হবে পুরনো সেতুগুলোতে। সংস্কারের মাধ্যমে এসব সেতুর এক্সেল লোড বাড়ানো গেলে নতুন ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালাতে সমস্যা হবে না।"
রেলওয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর উপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ৯৩ বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতু নিয়ে। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অধীন ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে চলে আসলেও কর্ণফুলি নদীতে নতুন সেতু নির্মাণের কাজ এখনো শুরুই করতে পারেনি। বর্তমান কালুরঘাট সেতু দৈর্ঘ্য ৬৩৮ মিটার এবং এর স্প্যান ১৯টি হলেও জীর্ণ এই সেতুটি দিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা রেলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। যার কারণে বুয়েটের সহায়তা নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে কালুরঘাট সেতুটি মেরামতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।