দখলে দূষণে হতশ্রী শ্যামাসুন্দরী
দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত রংপুরের শ্যামাসুন্দরী খাল। খনন না করাই মূলত এর জন্য দায়ী। ময়লা আবর্জনার ভাগাড় এখন এককালের স্বচ্ছসলিলা এ জলাধার। এক কথায় শ্যামাসুন্দরী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উপচে পড়ে শ্যামাসুন্দরী। তৈরি হয় জলাবদ্ধতাও। ফলে গতবছর রেকর্ড বন্যায় ভেসেছিল রংপুর নগরী।
স্থানীয় ব্যক্তি শাজাহান আলী বলেন, "অনিয়মে ভেস্তে গেছে সংস্কারের উদ্যোগও। পুরো শহরজুড়েই ছড়িয়ে আছে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল। দীর্ঘদিন খননের অভাবে দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে শ্যামাসুন্দরী। প্রার্থীরা প্রতি নির্বাচনেই প্রতিশ্রুতি দেন কিন্ত নির্বাচনে জয়ের পর তারা ভুলে যান।"
রাজা জানকি বল্লভ সেনের মায়ের নাম ছিল শ্যামাসুন্দরী। তিনি ম্যালেরিয়ায় মারা যান। তাই মশার উপদ্রব কমাতে ১৮৯০ সালে এই খাল খনন করান জানকি বল্লভ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় খালটি আবার মশাদের প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে পানি প্রবাহ। দখলের কারণে অনেক জায়গায় এর অস্তিত্বই বিলীন। খালটি সংস্কার ও এর দুইপাশের সৌন্দর্য বাড়াতে ২৫ কোটি টাকা ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, পুরোটাই চলে গেছে অনিয়ম আর দুর্নীতিতে।
আরেকজন স্থানীয় মোঃ মোফাজ্জল হোসেন বলেন, "রংপুর মহানগরীতে মশার উপদ্রব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মশারি বা মশক নিধন ওষুধ ছাড়া দিনেও ঘরে থাকা যায় না। আর দিনের আলো কমে আসতেই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। শ্যামাসুন্দরী ও ক্যাডি খাল সংস্কার না করলে এ থেকে রেহাই মিলবে বলে মনে হয় না।"
আরেক স্থানীয় মাহাবুব মিয়া থাকেন খালের পাড়ে। তিনি বলছিলেন, "১৩৫ বছর পুরোনো এ খাল। জানকি বল্লভ ছিলেন পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং ডিমলার রাজা। ১৮৯০ সালে খালটি উদ্বোধন করেন স্যার স্টুয়ার্ট কেভিন বেইলি। আবর্জনা তো দখল করেছেই, তার ওপর ৪৮২ জন দখলদার করেছে গ্রাস। খালটি দখলদারদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।"
সিও বাজার এলাকার নাসির উদ্দিন জানান, ঘাঘট নদীর উৎস মুখ থেকে শুরু হয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামাসুন্দরী খালটি নগরীর ভেতর দিয়ে খোখসা ঘাঘটের সঙ্গে মিলেছে।
৪০ থেকে ৯০ ফুট প্রশস্ত ছিল এই খাল। এখন কোথাও কোথাও বাকি আছে ৬ থেকে ৮ ফুট। অনেকে বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের লাইন খালের সঙ্গে সংযোগ করে দিয়েছেন।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রুহুল আমিন মিয়া জানান, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রংপুর পৌরসভায় খালটি খনন করা হয়েছিল। পরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১২ সালে প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সে সময়ে শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার, ওয়াকওয়ে ও খালের উপর সেতু নির্মাণকাজ শুরু করে। কিন্তু কিছুদিন পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড খালটি খননের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় আড়াই কিলোমিটার খাল খনন করে। অন্যদিকে, ক্যাডি খালও সংস্কার না করায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। এই কাজটি সম্পন্ন হলে সমস্যার সমাধান হবে।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের (রসিক) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ এমদাদ হোসেন জানান, শ্যামাসুন্দরী খালটিতে চারটি ব্রিজ পুনঃনির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে পানি প্রবাহ বন্ধ হতে পারে। আর মশার প্রকোপও বাড়তে পারে। তবে, মশা নিধনে কার্যকর ভূমিকা অব্যাহত রয়েছে। আর সিটি কর্পোরেশন চেষ্টা করছে যেন দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
রংপুর সিটি করপোরেশনের সহকারী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান বলেন, "কেবল ফগার মেশিনের ধোঁয়া দিয়ে পুরোপুরি মশা নিধন হয় না। তাই এখন হ্যান্ড স্প্রের সাহায্যে কীটনাশক ছিটিয়ে আধাঘণ্টা-এক ঘণ্টা পর ফগার মেশিনের ধোঁয়া ব্যবহার করা হচ্ছে।"
আরো ভুক্তভোগী
নগরীর খলিফাপাড়ার ইসহাক মিয়া বলেন, "শুধু ড্রেনগুলোতেই মশা মারা দেখি। আর অন্য কোথাও দেখা পাই না মশক নিধন কর্মীদের। মশার কামড়ে কোথাও স্থির থাকা যায় না। দিনের বেলায় মশারি দিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে।"
মহানগরীর মুন্সিপাড়ার শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম বলেন, "দিনের বেলা পড়তে বসলেও মশা কামড়ায়। মশারির ভিতর বসে পড়তে হচ্ছে। নগরীতে ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই মশার উপদ্রব বাড়ছে।"
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বলেন, "১০টি ফগার মেশিন দিয়ে প্রতি ওয়ার্ডে ৬ দিন করে ড্রেন ও ঝোপঝাড়ে মশা নিধন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। নতুন ৬টি ফগার মেশিন ক্রয়ের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। খাল পুনঃখনন এবং সংস্কারের জন্য সরকার প্রায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "ঐত্যিবাহী শ্যামাসুন্দরী খালের স্বরূপ ফিরিয়ে এনে এটিকে দখল এবং দূষণমুক্ত করে সৌর্ন্দয বর্ধন করা হবে।"