দুর্নীতির দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ প্রবর্তন করা হোক: হাইকোর্ট
দুর্নীতির লাগাম টানতে এই জঘন্য অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রবর্তন করা যেতে পারে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেছেন, "তারা (দুর্নীতিবাজ) শক্তিশালী, সংগঠিত এবং সিন্ডিকেটেড, ফলে গুরুত্বের নিরিখে দুর্বিনীত এবং দীর্ঘ সময়ব্যাপী দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্টদের মৃত্যুদণ্ডের প্রবর্তন করা যেতে পারে।"
পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ দলীয় আলোচিত এমপি হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।
গত ৯ মার্চ এই মামলায় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করলেও সর্বশেষ বুধবার পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষরের পর সেটি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট।
হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণের প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হাইকোর্ট মতামত দিয়েছেন, কিন্তু এই সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের দায়িত্ব জাতীয় সংসদের। জাতীয় সংসদ এ ধরনের আইন প্রণয়নে নিশ্চয়ই হাইকোর্টের মতামতকে অগ্রাধিকার দেবে।"
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, "হাইকোর্ট যথার্থই বলেছেন। তবে শুধু সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করেই দুর্নীতির মূল উৎপাটন সম্ভব নয়। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। এছাড়াও আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্ব দিতে হবে।"
গোলাম রহমান আরও বলেন, দুদকের যে ভূমিকা, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এই সংস্থাকে সেসব প্রশ্নের সমাধান করতে হবে, যাতে করে এটিকে একটি শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে জণগণ বিবেচনা করতে পারে।
দুদক আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তফসিলভুক্ত যে অপরাধ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং অপরাধের জন্য ১০ বছর এবং ১২ বছর সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে। এছাড়াও এইসব অপরাধের সাথে জড়িত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত এবং জরিমানার বিধান রয়েছে।
সাংবিধানিক পদধারী হলেও তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, "সাংবিধানিক পদধারী বা নন পদধারী তিনি যেই হোন না কেন, দুর্নীতিতে জড়িত থাকলে তাকে বিচারের আওতায় এনে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনার কারণেই দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে আমরা সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।"
আদালত বলেন, "আমরা সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, এখন পর্যন্ত দুদক এরকম হাজারো দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু এর জন্য চেষ্টা থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ওপর নির্ভর করে আছে।"
রায়ে দুর্নীতিকে মানসিক ব্যাধি আখ্যায়িত করে হাইকোর্ট বলেন, "এতে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবিশেষ আসক্ত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে দুদক, বিচার বিভাগসহ সরকারি-বেসরকারি এবং আদালতের প্রধানরা সমন্বিতভাবে তাদের সতর্ক করে বার্তা দেবেন। যদিও এ কাজ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। একজন সৎ ব্যক্তি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির খপ্পরে পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু তারপরও দুর্নীতিমুক্ত জাতি ও সমাজ গঠনে এ কাজ শুরু করতে হবে।"
এদিকে রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আত্মসমর্পণ না করলে তার বিরুদ্ধে বিচারিক (নিম্ন) আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দুদক আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, হাইকোর্ট হাজী সেলিমের ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ বহাল রাখায় তিনি তার সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।
তবে হাজী সেলিমের আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা বলেন, এই মামলায় আপিল বিভাগে আপিল করা হবে। তাই হাজী সেলিমের এমপি পদ হারানোর কোনো কারণ নেই।
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন বিচারিক আদালত।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য এরপর হাইকোর্টে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট তার সাজা বাতিল করেন।
কিন্তু পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে বসে দুদক। এরপর থেকে জামিনে ছিলেন এই সংসদ সদস্য।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে হাইকোর্টে হাজী সেলিমের মামলার আপিলের পুনরায় শুনানি করতে বলা হয়।
গত বছরের ৩১ জানুয়ারী পুনঃশুনানির পর ৯ মার্চ বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। তিন বছরের দণ্ড থেকে খালাস পান হাজী সেলিম।