ইনকিউবেটরে জন্ম নেওয়া ৫৩ বিপন্ন ‘বোস্তামী কাছিম’ ছেড়ে দেওয়া হলো পুকুরে
বোস্তামী কাছিম বা ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অত্যন্ত বিরল এবং চরমভাবে বিপন্নপ্রায় প্রজাতির কচ্ছপ। এর বৈজ্ঞানিক নাম: Nilssonia nigricans।
কয়েক দশক ধরে প্রজননস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ায় ও আবাসস্থল দূষণের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে প্রাণিটি।
বিপন্নপ্রায় বোস্তামী কাছিম সংরক্ষণে চট্টগ্রামে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ক্রিয়েটিভ এলাইয়েন্স। এরই অংশ হিসেবে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনায় ১১৫৫টি ডিম থেকে মোট ৩১১টি বোস্তামী কাছিমের বাচ্চা ফুটিয়ে তা পুকুরে অবমুক্ত করেছে সংস্থাটি।
বৃহস্পাতিবার ৫৩টি বোস্তামী কাছিমের ছানা চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামি পুকুরে অবমুক্ত করে সংস্থাটি।
প্রাণি বিজ্ঞানীরা বলছেন, বোস্তামী কাছিম শুধু মাত্র চট্টগ্রামে নয়; ভারতের ৯টি স্থানে, মিয়ানমারের আরাকান ও বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র অবিবাহিকার নদ-নদী অঞ্চলেও দেখা গেছে।
১৯৯৮ সালে বিপন্নপ্রায় প্রাণি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএন। ২০১২ সালে বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত করে বাংলাদেশ।
২০১৯ সাল থেকে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিপন্নপ্রায় বোস্তামী কাছিমকে সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ক্রিয়েটিভ এলাইয়েন্স।
সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী শাহরিয়ার রহমান সিজার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০১৯ সালে ৫৫ ডিম থেকে ৩৮টি বাচ্চা উৎপাদন করে বোস্তামী পুকুরে ছাড়া হয়। ২০২০ সালে ৭০০টি ডিম থেকে ২০৬টি বাচ্চা উৎপাদন হয়।"
"২০২১ সালে আমরা ৪০০টি ডিম সংগ্রহ করেছিলাম, সেখান থেকে ৬৭টি বাচ্চা উৎপাদন হয়েছিলো।নানা কারণে ১৪টি বাচ্চা মারা গেছে। আজ ৫৩টি বাচ্চা বোস্তামী পুকুরে ছাড়তে সক্ষম হয়েছি আমরা,"বলেন তিনি।
তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় এ মৌসুমে কাছিমের বাচ্চা উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে বলে জানায় সংস্থাটি।
"মূলত করোনার কারণে সঠিক সময়ে ডিম সংগ্রহ করতে না পারা ও আবহাওয়াজনিত কারণে এমনটা হয়েছে বলে ধারনা করছি। তবে প্রাকৃতিকভাবে আগে এর চাইতে বেশি ডিম নষ্ট হতো। যা এখন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে," বলেন শাহরিয়ার রহমান সিজার।
ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্সের এই উদ্যোগে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ বন বিভাগ ও মাজার কর্তৃপক্ষ। মাজার প্রাঙ্গণে অবস্থিত পুকুরটির দৈর্ঘ্য ৯৮ দশমিক ৮ মিটার এবং প্রস্থ ৬১ দশমিক ৩ মিটার।
বায়েজিদ বোস্তামী রা: মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "২০০৩ সালে দুর্বৃত্তরা বিষ প্রয়োগ করে পবিত্র মাজারের কাছিম হত্যার চেষ্টা করেছিলো। ওই ঘটনার পর বন বিভাগ ও প্রাণি গবেষকদের সহায়তায় কাছিম সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য মাজারের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছিল একটি কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র। এ কাজে মাজার কমিটি ও খাদেমরা সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছেন।"
কাছিম রক্ষায় বোস্তামী মাজার এলাকায় আরও একটি পুকুর খননের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন মাজারের সাধারণ সম্পাদক।
তিনি বলেন, "এতে কোনো কারণে একটি পুকুরের কাছিম ক্ষতিগ্রস্থ হলে অপর পুকুরের মাধ্যমে প্রজাতিটির সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যাবে।"
ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্সের একদল দক্ষ সেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে কাছিমের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রটি।
স্বেচ্ছ্বাসেবী উচ্ছ্বাস বড়ুয়া বলেন, "প্রতিবছর জুন-জুলাই মাসে প্রজনন মৌসুমে আমরা কাছিমের ডিম সংগ্রহ শুরু করি। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ডিম সংরক্ষণ করে বাচ্চা ফুটানো হয়। আগষ্ট মাসে কাছিম ছানাগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রজনন কেন্দ্রে। সেখানে ছয়মাস পর্যক্ষেণের পর ফেব্রুয়ারি মাসে কাছিমের বাচ্চাগুলোকে বোস্তামী পুকুরে উন্মুক্ত করা হয়।"
মাজার কর্তৃপক্ষ জানায়, আগে প্রজনন মৌসুমে মাজারের মূল পাহাড়ের পেছনে ও জঙ্গলে যত্রতত্র ডিম দিত কাছিম। এতে বিভিন্ন বন্যপ্রাণি ও পাখির মাধ্যমে ডিম ক্ষতিগ্রস্থ হতো। ফলে বাধাগ্রস্থ হতো কাছিমের প্রাকৃতিক প্রজনন।
এরমাঝেই ২০০৩ সালে দুষ্কৃতকারীরা মাজারের পুকুরে বিষ প্রয়োগ করলে বোস্তামী কাছিম বিলুপ্তির শঙ্কা দেখা দেয়। ওই সময় বন বিভাগ ও মাজার কমিটি কাছিমের প্রজননের জন্য একটি জায়গা সংরক্ষিত করে। ২০১৯ সাল থেকে ক্রিয়েটিভ এলাইয়েন্স ইনকিউবেটরের মাধ্যমে কাছিমের কৃত্রিম প্রজনন করছে।
১৯৩১ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী ম্যালকম স্মিথ তার ফনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ভারতবর্ষে 'নিলসোনিয়া নিগরিকেন টার্টেল' বা বোস্তামী কাছিম একমাত্র বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারে পাওয়া যায়।
স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, হযরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী (র.) ইরান থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় এ কাছিমগুলো নিয়ে আসেন।
কিন্তু, সাম্প্রতিক এ গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, বোস্তামী কাছিম বাংলাদেশ অঞ্চলের নিজস্ব প্রাণি। ২০১১-১২ সালে এ প্রজাতির কাছিম মুহুরী নদী ও নেত্রকোনার একটি জলাশয় থেকেও সংগ্রহ করে গবেষক দল।
আইইউসিএনের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে মোট ২৬০ জাতের কাছিম রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৩০ প্রজাতির।যার ছয়টি ছাড়া বাকি সবগুলোর নাম বিপন্নপ্রায় প্রাণির তালিকায় উঠেছে।
শত বছরের ওপরে আয়ু নিয়ে জন্ম নেওয়া বোস্তামী কাছিমের যে কটি জাত দেশের বিভিন্ন নদী-জলাশয়ে পাওয়া গেছে,তার দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। তবে বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারের কাছিমগুলোর দৈর্ঘ্য ৯০ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত। খয়েরি ও কালচে রঙের এ প্রাণী মূলত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জীবন ধারণ করতে পারে।