স্ত্রীকে হত্যা করে সাংবাদিক ছদ্মবেশে ১৭ বছর
২০০৫ সালে শ্বাসরোধ করে স্ত্রীকে হত্যার ১২ দিন পর জামিনে বের হয়ে সাংবাদিক ছদ্মবেশে ১৭ বছর পলাতক থাকা মো. আশরাফ ওরফে কামালকে (৪৭) গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বৃহস্পতিবার রাতে সাভার থেকে কামালকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত ২১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁও থানা থেকে একটি অভিযোগপত্রে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী কামালকে গ্রেপ্তারের জন্য র্যাবের কাছে অনুরোধ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে কামালকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এরপর মামলার কাগজে পাওয়া মোবাইল নম্বরের ভিত্তিতে বরিশালে একটি অভিযান চালানো হয়। মোবাইল নম্বরটি আসামীর নামেই রেজিস্ট্রেশনকৃত, কিন্তু ব্যবহার করছেন অন্যজন। আসামী দীর্ঘদিন মোবাইল নম্বরটি ব্যবহার না করায় মোবাইল কর্তৃপক্ষ সিমটি অপর ব্যক্তির কাছে রিপ্লেসমেন্ট সিম হিসেবে বিক্রি করেছে। ফলে কামালকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। র্যাব সাইবার পেট্রলিং এর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রেপ্তার কামালের ফুটপ্রিন্ট সনাক্ত করে। এরপর মাঠ পর্যায়ে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে।
এরই ধারাবাহিকতায়, র্যাব-১১ এর অভিযানে বৃহস্পতিবার রাতে সাভার এলাকা থেকে কামাল গ্রেপ্তার হয়। গ্রেপ্তারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং সংশ্লিষ্ট চার্জশিট পর্যালোচনায় জানা যায়, ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় পারিবারিক কলহের কারণে গ্রেপ্তারকৃত কামাল তার শিশুপুত্রের সামনে শ্বাসরোধ করে নিজ স্ত্রী সানজিদা আক্তারকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গোপন করার জন্য মৃতের ওড়না দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে লাশ ঝুলিয়ে দেয়। পরে প্রচার করে যে, তার স্ত্রী সানজিদা আত্মহত্যা করেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, এ সংক্রান্তে অপমৃত্যু মামলা হয়। লাশের সুরতহাল শেষে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে ঘটনাটি সন্দেহজনক হওয়ায় আসামীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। সে ১২ দিন পর তার শ্বশুরের সহায়তায় জামিন পান। জামিন পাওয়ার পরপরই হঠাৎ করে একদিন সে আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপনে থাকার সময় কখনই সে নিজ স্থায়ী ঠিকানা নোয়াখালী ও কর্মস্থল, নিজ সন্তান ও আত্মীয়দের কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি।
র্যাব জানায়, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর, শ্বাসরোধ করে সানজিদা আক্তারকে হত্যা করা হয়েছে বলে সোনারগাঁও থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। ওই মামলার একমাত্র আসামী কামাল। মামলার তদন্তে জানা যায় যে, সিলিং ফ্যানের নিচে খাট ছিল এবং খাটের উপর থেকে সিলিং ফ্যানের উচ্চতা খুবই কম ছিল।
এমতাবস্থায়, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়।
আরো জানা যায় যে, কামাল প্রায়ই তার স্ত্রী সানজিদা আক্তারকে মারধর করতো। সার্বিক তদন্তে সাক্ষ্যপ্রমাণে কামালের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩০২/২০১ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আসামীর বিরুদ্ধে সোনারগাঁও থানার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিচার শেষে মামলার পলাতক আসামী কামালকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
গ্রেপ্তারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আশুলিয়া এলাকায় সে ২০০৬ সালে সাপ্তাহিক মহানগর বার্তার সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হয়। এরপরে ২০০৯ সালে আশুলিয়া প্রেসক্লাবের সদস্য হয়। পরবর্তীতে সংবাদ প্রতিক্ষণ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। তিনি ২০১৩-১৪ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ২০১৫-১৬ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেসক্লাবের সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়। এরপর আশুলিয়া প্রেসক্লাবের ২০১৬-১৭ মেয়াদে নির্বাহী সদস্য পদ লাভ করে। ২০২০ সালে দৈনিক সময়ের বাংলা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে। ২০২১-২২ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেসক্লাবে পুনরায় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করে হেরে যায়। বর্তমানে সে আশুলিয়া প্রেসক্লাবের সদস্য এবং স্বদেশ বিচিত্রা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত।
র্যাব জানায়, এই দীর্ঘ সময়ে সে সংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন গার্মেন্টস ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। নিজে 'কমপ্লায়েন্স সলিউশন' নামে একটি কনসালটেন্সি ফার্ম খোলে। ফার্মটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ যাচাইয়ের নিরীক্ষার কনসালটেন্সি করত।
র্যাবের মুখপাত্র জানিয়েছেন, সাংবাদিকতা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ ও নজরদারি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন- এই ধারণা থেকেই স্ত্রীকে হত্যার পরে সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেয় কামাল।
র্যাব জানায়, কামাল ১৯৯৮ সালে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে বি.কম (পাস) করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত সিমেন্ট কোম্পানীতে ২০০১ সাল থেকে চাকরি শুরু করে। পরবর্তীতে সে ২০০৩ সালে ভিকটিমকে বিয়ে করে সস্ত্রীক কোম্পানীর স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাস শুরু করে। ঘটনার পর সে ছদ্মবেশে আশুলিয়ায় বসবাস শুরু করে এবং প্রথম স্ত্রীর ঘটনা গোপন করে পুনরায় বিয়ে করেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাকে গ্রেপ্তার এড়ানোর ছদ্মবেশ হিসেবে বেছে নেয়।