টিকিট কেটে ফুল দেখা! রাজশাহীর ড্রিমার্স গার্ডেনে এমনটাই ঘটছে
ফুল কে না ভালোবাসে? তাই বলে পকেটের টাকা খরচ করে ফুল দেখা! কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও, এই অদ্ভুত বিষয়টিই বাস্তবে রূপ দিয়েছেন হাসান আল সাদী পলাশ নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা। তার প্রতিষ্ঠিত ড্রিমার্স গার্ডেনে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল দেখতে তাই প্রতিদিন ভিড় করছেন ১০০-১৫০ জন মানুষ। একেকজন দর্শনার্থীর জন্য প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। সেই হিসেবে মানুষকে ফুল দেখিয়ে গড়ে মাসিক আয় তার ২ লাখ টাকার মতো।
হাসান আল সাদী বলেন, 'ফুল দেখার জন্য জনপ্রতি প্রবেশ ফি ৫০ টাকা দিতে হয়। বিষয়টি অদ্ভুতই বটে! যেখানে সাভারের বিরুলিয়ার গোলাপগ্রাম কিংবা খুলনা অঞ্চলের ফুলচাষের গ্রামগুলোতে ফুল দেখতে কোনো টাকা দিতে হয় না। আমি নিজেই সেখানে গিয়ে ফুল দেখে এসেছি। অথচ আমার বাগানে ঢুকে ফুল দেখতে হলে জনপ্রতি ৫০ টাকা ফি দিতে হচ্ছে। আমি নিজেও কখনো ভাবিনি এটা সম্ভব হবে। এবারই পরীক্ষামূলক বিষয়টি করেছি। শনি ও শুক্রবার ছুটির দুইদিন ভিড় বেশি থাকে। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৫০ থেকে ২০০ জন ফুল দেখতে আসেন। সপ্তাহের অন্যান্য দিন গড়ে ১০০ জন দর্শনার্থীর উপস্থিতি থাকে।'
হাসান আল সাদী পলাশের ড্রিমার্স গার্ডেন গোদাগাড়ীর পলাশবাড়ী গ্রামে অবস্থিত। সেখানেই ১৩ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এটি। রাজশাহী শহরের কাশিয়াডাঙ্গা মোড় থেকে দামকুড়াহাট পার হয়ে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার গেলে রাস্তার পাশেই পড়বে ড্রিমার্স গার্ডেন। বরেন্দ্র অঞ্চলের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌঁছানো যায় পলাশবাড়ীতে।
ড্রিমার্স গার্ডেন প্রধানত দেশীয় জাতের আমের একটি বাগান। সেখানে ৩৭০টি দেশী জাতের আমের গাছ রয়েছে। সেই গাছের ফাঁকে ফাঁকে মাটির ওপর টবে তিনি ২০ থেকে ২৫ জাতের ফুলের চাষ করেছেন। টবেই ফুল ফুটিয়ে সেইসব দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শন করছেন। পুরো বাগান জুড়ে শোভা পাচ্ছে সেইসব ফুল। বাগানের বিভিন্ন স্থানে সারিবদ্ধভাবে টবে যেমন রাখা হয়েছে ফুলগাছগুলো, আবার শেড করে টবে রেখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ফুলগাছ।
তবে এজন্য আম গাছের ডালগুলো ছেঁটে দিতে হয়েছে, যেন ফুল গাছের ওপর আলো পড়ে।
এমনকি প্রতিটি আম গাছের ডালে ডালে প্রদর্শনীর জন্য টবে করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নানা রঙের ও বর্ণের ফুলের গাছ। বাগানে ঢুকলেই মনে হবে এক অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করেছি। ফুলের এক অন্য রাজ্যে। সেই রাজ্যে শোভা পাচ্ছে টিউলিপ, গ্লাডিওলাস, পিটুনিয়া, সেলোসিয়াসহ অসংখ্য নাম না জানা ফুল। শুধু কি তাই, বাগানের মাঝে মাঝে দর্শনার্থীদের বসার জন্য রাখা হয়েছে চেয়ার...এক অদ্ভুত মনোরম পরিবেশ! তাই তো দর্শনার্থীরা ফুল দেখার সাথে সাথে ফুলের সাথে ছবি তুলছেন। বাগানের মধ্যে রয়েছে পুকুর। সেই পুকুরের পাড়ের চারপাশে ফুলের গাছ তো সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছেই, সাথে পুকুরে রাখা একটি নৌকাও সাজিয়ে তোলা হয়েছে ফুলের গাছে।
হাসান আল সাদী জানান, আম বাগান এই জমিতে ১৮ বছর ধরে আছে। ফুলের বাগান এ বছরই প্রথম। শীতকালীন ফুল দিয়েই শুরু বলা যায়। আসলে সুপরিকল্পিতভাবে এই বাগানটি গড়ে তোলা হয়নি। বলা যায়, প্রয়োজন থেকেই ফুলের বাগান করা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার চারা এনে, সেই চারাগুলো টবে বড় করে সেখানে ফুল ফুটানো হয়েছে। এরপর তা প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। ২৫ হাজারের মতো চারাগাছ নিয়ে আসলেও অনেক চারা মরে গেছে। প্রকৃতি ও আবহাওয়ার সাথে টিকতে পারেনি। তবে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সফলতাই বলা যায়। এজন্য আগামিতে ফুলগুলো টবে চাষ না করে বেডে করার চিন্তাভাবনা আছে।
তিনি জানান, 'আলাদা একটি শেডে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে দেলোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে ১০০০টি টিউলিপ বাল্ব নিয়ে এসে লাগিয়েছিলাম। বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিচর্যার মাধ্যমে এই বাগানে টিউলিপ ফুটেছিলো। মধ্য জানুয়ারি পর্যন্তও বাগানে টিউলিপ ফুল ছিলো। তখন দর্শনার্থীদের সমাগম আরও বেশি ছিলো। তবে তাপমাত্রা বাড়ায় ফুলগুলো ঝরে গেছে।'
'বরেন্দ্র অঞ্চলে ফুল চাষ একটি চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া। আম বাগানের ভেতর ফুলচাষ করা আরও চ্যালেঞ্জিং। আমি কখনো ভাবিনিই যে, আম বাগানে ফুলচাষ করা সম্ভব হবে। এইজন্য স্বল্প পরিসরে টবে ফুল চাষ করেছি। ফুলের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে আমার পরিকল্পনা আরও বেড়ে গেছে। আগামীতে বড় পরিসরে যাতে করা যায় সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি। বিশেষ করে যাতে ১২ মাস আম বাগানে ফুল রাখা যায় সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি। যদিও তা কঠিন। বর্ষাকালে গাছ টিকবে কি না, তখন পরিস্থিতি কেমন হবে, সব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি।'
তবে এই ফুলের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষি পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। আগামীতে জার্মেনিশানের মাধ্যমে সারাবছর ফুল প্রদর্শনী ও চারা গাছ বিক্রির পরিকল্পনা আছে বলে জানান তিনি।
প্রতিদিন নানা পেশার, নানা বয়সের মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন হাসান আল সাদী পলাশের ড্রিমার্স গার্ডেনে। গত শনিবার ড্রিমার্স গার্ডেনে গেলে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বিভিন্ন দর্শনার্থীর। তাদের মধ্যে ছিলেন আদালতের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকার, চিকিৎসকসহ নানা পেশার মানুষ। ছিলো শিশুরাও। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাহিদ হোসেন বলেন, 'আমি রাজশাহীর সন্তান । বেশ কিছুদিন ধরে ড্রিমার্স গার্ডেনের কথা শুনছিলাম। তাই ছুটিতে রাজশাহী এসেই তড়িঘড়ি করে আজ ড্রিমার্স গার্ডেনে চলে এসেছি। এসে এর পরিবেশ দেখে আমি অভিভূত। আশা করছি, আগামী দুই-তিন বছরে শুধু লোকাল ভিজিটরস না, ট্যুরিস্টও আসবে এই ড্রিমার্স গার্ডেনে ফুল দেখতে। ট্যুরিস্ট আসা শুরু করলে এই অঞ্চলে কৃষি পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব হবে।'
একই দিন ড্রিমার্স গার্ডেন দেখতে আসেন বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহীর শাখার ডিজিএম কাওসার কামাল। তিনি বলেন, 'আমি টিউলিপ ফুল দেখতে এসেছিলাম। তবে এসে দেখি টিউলিপ ফুল মৃত। প্রধানত আবহাওয়ার কারণেই টিউলিপ ফুল বাঁচেনি। তবে টিউলিপ দেখতে না পেলেও এখানকার পরিবেশ দেখে আমি মুগ্ধ। নানা বাহারী ফুলগাছ টবে করে আম গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই আইডিয়াটা আমার নতুন মনে হয়েছে। তবে এটা এখনো রাইজিং পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি ভবিষ্যতে এটি আরও বড় পরিসরে বিস্তৃত হবে। কারণ রাজশাহীতে সেই অর্থে ভ্রমণ করার মতো জায়গা নেই। এই আইডিয়াটা তার কিছুটা পূরণ করবে।'