গভীর সমুদ্র বন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাওয়ার কোনো সড়ক নেই
মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মহেশখালীর গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ প্রায় শেষের দিকে হলেও প্রকল্প দুটির আশপাশের রাস্তাগুলোর কাজ এখনও শেষ হয়নি।
কক্সবাজারের মহেশখালীর দুর্গম দ্বীপ মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রস্তাবিত কেন্দ্রে স্থল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মা্ধ্যমে নির্মাণ কাজ সহজ করতে কনস্ট্রাকশন অভ মাতারবাড়ী কোল বেজড পাওয়ার জেনারেশন সেন্টার লিঙ্ক রোড বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে।
কাজ শুরুর সাত বছর পর এখন ২০২৪ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ (আরএইচডি)।
৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণ, পুনর্বাসন ও সংস্কারের কাজ লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ করতে পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করা শ্রমিক ও প্রকৌশলীরা সহজেই যাতায়াত করতে পারতেন। কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতিও পাঠানো যেত সড়কপথেই।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, বর্তমানে বিদ্যুৎ প্রকল্পের শ্রমিক ও প্রকৌশলীদের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌপথ।
আরএইচডি প্রথমে লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে এক দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এখন আরেক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে সংশোধনী পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে আরএইচডি। এ প্রস্তাব অনুমোদন পেলে সড়ক নির্মাণে বাড়তি সময় লাগবে চার বছর।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হলেও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায় ২০২৪ সালের মধ্যেই ইউনিট টেষ্টিং শেষ করতে চায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড।
এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার আয়োজন করে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটির অনুমোদন পেলে পাঁচ বছরের প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ৯ বছরে।
তবে এরকম পরিস্থিতি নতুন নয়। মহেশখালী ও মাতারবাড়ী ঘিরে মেগা পরিকল্পনার আওতায় সরকারের নেয়া প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের সংযোগ সড়কেই এমন অবস্থা বিরাজ করছে।
১১ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে আটটি প্লট উন্নয়নে মহাখালী পাওয়ার হাব প্রকল্পের সঙ্গে এখনও উন্নত সড়ক সংযোগ গড়ে উঠেনি।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে নেয়া ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে নেয়া প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক ব্যয় হবে বন্দর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে।
২০২৫ সালের মধ্যে বন্দরটি চালুর পরিকল্পনা থাকলেও সড়ক নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
বন্দরটি ব্যবহার করতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন সড়ক নির্মাণ বা বিদ্যমান সড়ক প্রশস্তকরণের কাজও শুরু হয়নি।
সংযোগ সড়কের অভাবে বড় প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, সংযোগ প্রতিষ্ঠা না করে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন। তাছাড়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও তা থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলেই চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে বিপুল পরিমাণ জাহাজ ভিড়বে মাতারবাড়ীতে।
বন্দর থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ না হলে এ বন্দর কোনো কাজে লাগবে না।
শামসুল হক আরও বলেন, বন্দরটি চালু হলেই কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম সড়কের ওপর চাপ বাড়বে কয়েক গুণ।
পরিববহন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সড়ক নির্মাণ না করে গভীর সমুদ্র বন্দর চালু করা হলে তা পণ্য পরিবহনে কোনো কাজে লাগবে না।
বিলম্বের কারণ কী?
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ৪৩ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, সংস্কার ও পুনর্বাসনে নেয়া প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০২ কোটি টাকা।
পরবর্তীতে ৬৬০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে এর প্রথম সংশোধনী অনুমোদন দেয়া হয়। তবে আরেক দফা মেয়াদ বাড়ানোর ফলে এই ব্যয় এখন ১ হাজার ২৭ কোটি টাকায় পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা প্রাথমিক ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ।
এখন পর্যন্ত সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়ে ৭২ শতাংশেরও কম। সংশোধিত প্রস্তাব অনুসারে, সড়কের কাজ হবে ২৭ দশমিক ২৬ কিলোমিটার।
কাজের পরিধি কমে এলেও বাড়তি ব্যয় হবে ৪২৫ কোটি টাকা, যা মূল বরাদ্দের ৭১ শতাংশ বেশি।
প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, মূল প্রকল্পে কোহেলিয়া নদীর ওপর ৫৪০ মিটার সেতু নির্মাণের কথা থাকলেও সংশোধিত প্রস্তাবে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ৮৯৫ মিটারে। এ কারণে ৪০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হবে। এছাড়া প্রকল্পে নতুন করে ৪০ মিটার আরসিসি গার্ডার সেতু যোগ হওয়ায় ব্যয় বাড়বে ৩২ কোটি টাকা।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে খরচ তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
মূল প্রকল্পে ১০ দশমিক ৩১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে বরাদ্দ চিল ৯৬ কোটি টাকা। সংশোধিত প্রস্তাবে দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারে নামলেও বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২০১ কোটি টাকা।
সড়ক নির্মাণের পরিমাণ ২ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার কমলেও ব্যয় বাড়ছে ১০৪ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা।
কিলোমিটারপ্রতি সড়ক নির্মাণের ব্যয় ৯ দশমিক ৩১ কোটি টাকা থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ২৭ দশমিক ২৮ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার কারণ জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পটির পরিচালক মো. ফজলে রাব্বির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে প্রকল্পের মেয়াদকাল শুরু হলেও একনেকে অনুমোদনের পর সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয় পরের বছরের জানুয়ারিতে।
তাছাড়া ১৯৮২ সালের আইন অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব তৈরি করা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে নতুন আইন হওয়ায় নতুন প্রস্তাব তৈরি করতে হয়েছে। এর ফলে ভূমি অধিগ্রহণেই চলে যায় আড়াই বছর।
তিনি আরও বলেন, দুর্গম এলাকায় সড়ক নির্মাণের কাজ অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবেও কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, কোহেলিয়া নদীর ওপর পাঁচ মিটার উচ্চতার সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তীতে এর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার নির্ধারণ করে দেয় বিআইডব্লিওটিএ।
এর ফলে সেতু নির্মাণের ব্যয় বেড়েছে।
সড়কবিহীন গভীর সমুদ্র বন্দর
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এ প্রকল্পের জন্য ৮ হাজার ৮২১ কোটি টাকা বরাদ্দ পায় আরএইচডি।
এর মধ্যে ২১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়ক নির্মাণে ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা এবং সেতু নির্মাণে ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা ছিল। ২০২০ সালের মার্চে অনুমোন পাওয়া প্রকল্পের সড়ক অংশের কাজ এখনও শুরু হয়নি। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক উন্নয়নের কাজই শুরু হয়নি
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এক লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সঙ্গে গত বছরের আগস্টে ঋণচুক্তি হলেও এত দিনে প্রজেক্ট মেমোরেন্ডাম সই করতে পারেনি আরএইডি। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরির কাজও শেষ করতে তারা।
আরএইচডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শ্যামল কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, চলতি বছরেই ডিপিপি চূড়ান্ত করে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া যাবে।
সেই পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান সব ডকুমেন্ট তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেবে। এরপর সেগুলো মূল্যায়ন করে দরপত্র ডেকে ঠিকাদার নির্বাচন করে নির্মাণকাজ শুরু করতে ২০২৩ সাল নাগাদ লাগতে পারে।
২০২৪ সালে কাজ শুরু হলে ২০২৭ সালের আগেই নির্মাণ শেষ হবে।
প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে আটকে আছে জাইকার প্রতিশ্রুত ১৪৬ দশমিক ৮ কোটি টাকা।
২০২৫ সালে মাতারবাড়ীতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হওয়ার কথা ছিল। চালু হলে এ বন্দরে দিনে গড়ে ৪ হাজার কার্গো ভেসেল হ্যান্ডল করা যেত।
আরএইচডি জানায়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে পৃথক এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা থাকায় প্রকল্পটি অনুমোদনে বিলম্ব হচ্ছে।
এই অবস্থায় এই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৪টি বাইপাস এবং একটি ওভারপাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই কাজও ২০২৫ সালের আগে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
জানা গেছে, জাপানি প্রতিষ্ঠান 'নিপ্পন কোয়েই' বাইপাস-ওভারপাসের মাঠ পর্যায়ের জরিপ কাজ শেষ করেছে ইতোমধ্যে।
এর ভিত্তিতে ডিপিপি তৈরি, জাইকার সঙ্গে ঋণ নিয়ে সরকারের আলোচনার কাজ শেষ হবে। বিস্তারিত নকশা, দরপত্র তৈরিসহ সব কাজ করতে ২০২৬ সালও পেরিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে (পিপিপি) ভিত্তিতে পৃথক সার্ভিস লেনসহ চার লেনের সড়ক নির্মাণ করতে পৃথক সমীক্ষার কাজ শেষ হয়ে আসছে।
সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালনা করা সমীক্ষার খসড়া ইতোমধ্যেই পিপিপি অফিসে জমা দিয়েছে বুয়েট।
পিপিপি অফিসের মহাপরিচালক আবুল বাশার জানান, বুয়েটের সমীক্ষা প্রতিবেদনটি আরএইচডিতে পাঠানো হয়েছে।
তিনি জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী জাপানের মারুবিনি করপোরেশন। প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা পর্যালোচনা করে প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হবে।
বিনিয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তির পর কাজ শেষ করতে ২৪ থেকে ৩০ মাস সময় লাগবে বলেও তিনি জানান।
আরএইচডির পিপিপি সেলের সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে মোহাম্মদ ফজলুল করিম টিবিএসকে জানান, বুয়েটের করা সমীক্ষা প্রতিবেদনটি তিনি হাতে পেয়েছেন। বিস্তারিত পর্যালোচনা শেষে এ প্রতিবেদন গ্রহণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ বিষয়ে বলেন, গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফিডার ভেসেলে রফতানি পণ্য অন্য কোনো দেশের বন্দরে পাঠাতে হয়। সেখান থেকে তা ওঠানো হয় মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজে। এর ফলে পরিবহনে সময় ও অর্থ ব্যয় হয় বেশি।
তিনি বলেন, গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে এ সমস্যার অবসান হবে। এর ফলে বহির্বাণিজ্যে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। তবে সড়কের প্রশস্ততা না বাড়লে- ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।