জাপানি অর্থায়নের মেগা প্রকল্প আরও ব্যয়বহুল হচ্ছে
ঢাকার যানজট কমিয়ে এনে সড়কে গতি আনার জন্য নেওয়া রাজধানীর তিন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের চুক্তিমূল্য এবং সময়সীমা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের কাছে দাবি জানিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।
করোনার কারণে প্রকল্পের কাজে ধীরগতি, শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা কমে আসা, স্বাস্থ্যগত সুরক্ষায় বাড়তি ব্যয়, উপকরণের দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বাড়তি সময় চেয়ে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) চিঠি দিয়েছে জাপানের ঢাকাস্থ দূতাবাস।
ওই চিঠিতে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নোয়াকি নিজ দেশের পরাার্মক ও ঠিকাদারদের স্বার্থ সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। এই তিন প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ নমনীয় সুদে ঋণ দিচ্ছে জাইকা।
ঢাকার প্রকল্পগুলোতে ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির দাবি পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে জাইকার অর্থায়নে নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ১৫ মন্ত্রণালয়ের সচিবের পাশাপাশি ৪৩ প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দিয়েছে ইআরডি। চিঠিতে জাপানের চাহিদা পূরণ করতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে কী পরিমাণ বাড়তি সময় লাগবে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একইভাবে প্রকল্পের ব্যয় কী পরিমাণ বাড়বে, তা-ও জানতে চেয়েছে ইআরডি।
কিন্তু অর্থনীতিবিদ এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা জাইকার দাবি বিনা-বাক্যব্যয়ে মেনে না নিয়ে, কেস-টু-কেস বিশ্লেষণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে সরকারকে দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
আগে থেকেই বাস্তবায়নে ছিল ধীরগতি, এখন যোগ হয়েছে সময় বৃদ্ধি
ঢাকায় জাইকার অর্থায়নের তিন প্রকল্পের দুটিই—বিমানবন্দর-নতুনবাজার-কমলাপুর এবং হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রো রেল প্রকল্প—এখনও প্রারম্ভিক পর্যায়েই আছে। তবে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রো রেল প্রকল্প এখন শেষের পর্যায়ে আছে।
বিমানবন্দর-কমলাপুর মেট্রো রেল লাইন (এমআরটি-১) এবং হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রো রেল (এমআরটি-৫) প্রকল্প দুটি ২০১৯ সালে একনেকের অনুমোদন পায়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনা মহামারির কারণে শুরুতেই দুই বছর পিছিয়ে গেছে প্রকল্পগুলোর কাজ।
ইতোমধ্যে এমআরটি-৫-এর (উত্তর রুট) ব্যয় ১১ শতাংশ বাড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে জাইকা। সময়মতো কাজ শুরু না হলে ব্যয় বাড়বে এমআরটি-১ প্রকল্পেও।
আর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল নির্মাণে (এমআরটি-৬) ২০১২ সাল থেকে চলে আসা প্রকল্পেও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
সরকারের এই তিন মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। এই তিন প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ নমনীয় সুদে ঋণ দিচ্ছে জাইকা।
সিংহভাগ অর্থ জোগান দেয়ার সুবাদে এই প্রকল্পগুলোতে পরামর্শক সেবা থেকে শুরু করে মালামাল সরবরাহ ও নির্মাণকাজের অধিকাংশের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট আছে জাপানের ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
জাইকা বাংলাদেশে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজ শুরু করে ২০১৩ সালে। একই সময়ে তারা জাকার্তায় প্রায় ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলের কাজও শুরু করে, যার মধ্যে ৫ কিলোমিটার সাবওয়েও রয়েছে। জাকার্তার মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ তারা দ্রুত শেষ করেছে এবং ২০২০ সালে ইন্দোনেশিয়ান সরকার তা চালু করেছে। অথচ ঢাকার মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ কবে শেষ হবে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জাইকার অর্থায়নে ৩৩টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭২ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা থেকে পাওয়া যাবে ২ লাখ ১ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয়ের ৭৪ শতাংশের বেশি ঋণ দিচ্ছে জাইকা।
কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) কিংবা চীনের চেয়েও কম সুদে ঋণ দিয়ে থাকে জাইকা। বিভিন্ন ধরনের ফি যোগ করলেও এ সংস্থার ঋণের সুদের হার ১ শতাংশের মধ্যেই থাকে।
ইতিমধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক নির্মাণের ব্যয়
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ৫১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জাইকা দিচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগ সড়কের জন্য আরও ৫০৫ কোটি টাকা এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্কের জন্য ৯৪৯ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে সংস্থাটি।
মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সঞ্চালন নেটওয়ার্কের কাজের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে। কিন্তু সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সম্প্রতি প্রকল্পের সময়সীমা ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।
সড়কের নির্মাণব্যয়ও বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
মাতারবাড়িতে চলমান ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের জন্যও ১২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে জাইকা। এর মধ্যে মূল বন্দর নির্মাণে ৬ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা এবং বন্দরের সঙ্গে সংযোগ সড়ক নির্মাণে ৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা দেবে সংস্থাটি। বন্দরে ইতিমধ্যে সীমিতসংখ্যক বিদেশি জাহাজ ভিড়তে শুরু করেছে। কিন্তু সড়ক নির্মাণের কাজ এগিয়েছে মাত্র ১ শতাংশের মতো।
জাইকার অর্থায়নে অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতীতে দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালীকরণ, কর্ণফুলী ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট (ফেজ ২) এবং চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড।
কোভিডের আগেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছিল শামুকের গতিতে
জাইকার অর্থায়নে বন্দরনগরীর পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত যুক্ত করার জন্য ২ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১১ সালে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এ পর্যন্ত ২ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা পেয়েছে।
সর্বশেষ এ প্রকল্প সম্পন্ন করার সময়সীমা ছিল গত বছরের ডিসেম্বর। তখন পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ।
২০১৩ সালে শুরু হওয়া চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্ণফুলী ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট (ফেজ ২)-এর অগ্রগতি এখন ৫৬ শতাংশ। ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকার এ প্রকল্পে জাইকা দিচ্ছে ২ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। আগামী বছর প্রকল্পটির সর্বশেষ ডেডলাইন শেষ হবে।
২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অগ্রগতি প্রায় ৫০ শতাংশ।
ন্যাচারাল গ্যাস এফিশিয়েন্সি প্রজেক্টের আওতায় ধানুয়া-এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত একটি গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ ২০১৪ সাল থেকে চলমান রয়েছে। ২০১৫ সালে তিতাস গ্রাহকদের জন্য একটি প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রকল্প চালু হয়। প্রকল্প দুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছর। কিন্তু দুটি প্রকল্পের কাজই এগোচ্ছে শামুকের গতিতে।
কেস-বাই-কেস বিশ্লেষণের পরামর্শ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জাপান শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতসহ অন্যান্য দেশেও অর্থায়ন করে। তবে দ্বীপ রাষ্ট্রটি অন্য কোনো দেশে এ ধরনের ব্যয় সংশোধনের দাবি জানায়নি।
জাইকার দাবি মেনে নিলে বিদেশি অর্থায়নকারীও সরকারের কাছে একই ধরনের আবদার নিয়ে হাজির হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'কোভিডের ওপর দায় দিয়ে জেনারেলাইজড করে সব প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হবে না।'
'বরং প্রতিটি প্রকল্প কেস-বাই-কেস বিশ্লেষণ করা দরকার, যে, কোভিডের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কতটা ব্যাহত হয়েছে এবং অন্যান্য কারণে কতটুকু হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের উচিত হবে অর্থায়নকারীদের সঙ্গে দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়ানো।