বিদেশে কর্মসংস্থানের ৫০ শতাংশই ১০ জেলার মানুষের দখলে
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ মানুষ চাকরির খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমান তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ সালে প্রবাসে শ্রমিক যাওয়ার গতি কিছুটা থমকে যায়।
এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের মতো মানুষই গেছেন দেশের ১০ জেলা থেকে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের এ জেলাগুলোতে আগে থেকে বিদেশে যাওয়া মানুষদের কল্যাণে প্রতিবছর বেশি সংখ্যক মানুষ নতুন করে প্রবাসী হওয়ার সুযোগ পান।
নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার কারণে এভাবে কিছু সুনির্দিষ্ট জেলার মানুষ বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকছেন বলে মত এই খাত সংশ্লিষ্টদের।
প্রবাসে কাজের সুযোগ লাভ করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাসহ- খুলনা, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির মানুষেরা।
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করতে শুরু করে। তখন কর্মী হিসেবে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছিলেন।
এরপর সেখানে কাজ করতে করতে তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই তারা নিজেদের অঞ্চলের মানুষদেরও বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। এমনটা জানিয়েছেন রিফউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (আরএমএমআরইউ)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনীম সিদ্দিকী।
'শুরুর দিকের প্রবাসীরা তাদের পরিচিতদের বিদেশে আনার ব্যবস্থা করেন। এভাবে এসব জেলায় একটি জোরালো নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে,' বলেন ড. তাসনীম সিদ্দিকী।
এই নেটওয়ার্ককে 'একটি শক্তিশালী প্রভাবক' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ড. তাসনীম। তিনি বলেন, 'অভিবাসনের ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বাইরে ব্যক্তিগত যোগাযোগ (নেটওয়ার্ক) খুব ভালো কাজ করে। অনেক অভিবাসী তাদের আত্মীয়স্বজনের জন্য নিজেদের নিয়োগকারীদের কাছ থেকে ভিসার ব্যবস্থা করে ফেলেন।'
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯১ লাখ ৯২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৫ লাখ চার হাজার তথা প্রায় ৪৯ শতাংশ মানুষ বিদেশ গিয়েছেন দেশের ১০টি জেলা থেকে। বাকি ৪৬ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ প্রবাসী হয়েছেন বাকি জেলাগুলো থেকে।
এ সময় পরিক্রমায়, বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা জেলা। এখান থেকে ৯ লাখ ৬৪ হাজার মানুষ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল চট্টগ্রাম। এ জেলা থেকে ৭ লাখ ২৬ হাজার মানুষ প্রবাসে কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন।
একইভাবে ২০০৫ থেকে ২০২০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৪ লাখ ৯৩ হাজার, টাঙ্গাইল থেকে ৯ লাখ ৪৩ হাজার, ঢাকা থেকে ৪ লাখ ৪ হাজার, চাঁদপুর থেকে ৩ লাখ ৬৭ হাজার, নোয়াখালী থেকে ৩ লাখ ৪৯ হাজার, নরসিংদী থেকে ২ লাখ ৬ হাজার, মুন্সিগঞ্জ থেকে ২ লাখ ৫৯ হাজার ও ফেনী থেকে ২ লাখ ৩২ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন।
শীর্ষে থাকা ১০টি জেলাসহ কেবল ১৬টি জেলা থেকে দুই লাখের বেশি কর্মী বিদেশ গিয়েছিলেন।
অভিবাসন-বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অভিবাসনের ক্ষেত্রে শীর্ষে থাকা এসব জেলার অনেক মানুষের দেশে কাজ করার কোনো ইচ্ছাই নাই। তারা কেবল বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। পূর্বজদের দেখে তাদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়।'
তিনি বলেন, 'যেসব জেলা থেকে মানুষের অভিবাসন ঘটে, সেখানে আমরা একটা প্যাটার্ন দেখতে পাই। সিলেটের মানুষজন সেই ১৯৪০-এর দশক থেকেই ইউরোপে যাচ্ছে। যেমন ধরুন, জাহাজের খালাসি হয়ে কেউ ইউরোপ থেকে বিলেত চলে গেলেন। তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে গেলেন। এরপর তার সাহায্য নিয়ে তার আত্মীয়-পরিজনও বিলেত চলে গেল। এটা একটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঝোঁক।'
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলোতে এ ধরনের কোনো প্যাটার্ন তৈরি হয়নি। ফলে এখানকার লোকেরা অভিবাসনের ক্ষেত্রে বিশেষ ঝোঁক দেখান না।
আসিফ মুনীর বলেন, 'এক্ষেত্রে কোনো অর্থনৈতিক প্রভাবক কাজ করে না। উত্তরের এ জেলাগুলোর মানুষেরা বিদেশ যাওয়াকে কোনো বিকল্প হিসেবে দেখেন না। তারা দেশের ভেতরেই কাজ করতে চান।'
উত্তরের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে কেবল বগুড়া ও পাবনাই অভিবাসী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে। গত ১৫ বছরে এই দুই জেলা থেকে এক লাখের বেশি মানুষ বিদেশ গিয়েছেন।
যেসব জেলা থেকে সবচেয়ে কমসংখ্যক মানুষ বিদেশে গিয়েছেন সেগুলো হলো, রাঙামাটি, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, খাগড়াছড়ি, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, শেরপুর, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল বাশার বলেন, 'এখানে একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, আপনাকে বিদেশ যেতে হলে জমি বিক্রি করে যেতে হবে। উত্তরের জেলাগুলোতে কৃষির ফলন ভালো। তাই ঐতিহাসিকভাবেই এখানকার মানুষেরা কখনো অভিবাসী হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি।'
তবে বর্তমানে অভিবাসন খরচ কমে গেছে উল্লেখ করে আবুল বাশার বলেন, 'আমরা চাই উত্তরের জেলাগুলোসহ অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অঞ্চল থেকে আরও মানুষ বিদেশ যাক। এর আগে ওসব অঞ্চলে অল্পসংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সি ছিল। তবে এখন রাজশাহী ও খুলনায় আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক এজেন্সি কাজ করছে। আর এসব অঞ্চল থেকে ক্রমশ অধিক সংখ্যক মানুষ বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন।'
আসিফ মুনীর বলেন, 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মটো হচ্ছে কেউ পিছিয়ে থাকবে না। তাই সরকার পিছিয়ে পড়া জেলাগুলো থেকে অভিবাসীর সংখ্যা বাড়াতে কাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতেও অভিবাসন বাড়াতে চেষ্টা করছে সরকার।'
তবে এটুকুই যথেষ্ট নয় বলে যোগ করেন মুনীর। তার মতে, মানুষকেও অভিবাসনের ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাতে হবে। তারা দেখতে চাইবে তাদের আশেপাশের মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ লাখ ১৭ হাজার মানুষের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হয়। করোনাভাইরাসের আগের বছর, ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭ লাখের বেশি। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০ সালে বাইরের দেশে কাজের সংখ্যা কমে ২ লাখ ১৭ হাজারে নেমে আসে।
মহামারির আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রতি মাসে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার বাংলাদেশি পাড়ি জমাত। বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি বড় অংশ যায় সৌদি আরবে। এ দেশটি থেকে গত বছর ৭৪ শতাংশ বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়। এর পরে রয়েছে ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, জর্ডান, ও কাতার।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ৩৮ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।