বেনাপোল বন্দরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বৃষ্টির মতো বোমার বিস্ফোরণ, আহত ১০
বেনাপোল স্থলবন্দরের হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোমবার বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক বোমাবাজি হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন ও বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের সমর্থক শ্রমিকদের মধ্যে এই বোমাবাজি হয়। এতে ১০ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২ জনকে আটক করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশি সূত্রে জানা গেছে, সাবেক বন্দর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক ও বেনাপোল পৌর কাউন্সিলর রাশেদ আলীর নেতৃত্বে বহিরাগত একটি দল সোমবার (২৮ মার্চ) সকালে বন্দর এলাকায় শতাধিক শক্তিশালী হাতবোমার (ককটেল) বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় বন্দর শ্রমিকরা বন্দরে মালামাল লোড-আনলোড করছিল। বোমার শব্দ পেয়ে তারা কাজ বন্ধ করে লাঠিসোটা নিয়ে একজোট হয়ে রাস্তায় নেমে এলে বহিরাগতরা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় বন্দরে কর্মরত কাস্টমস, বন্দর, সিএন্ডএফ এজেন্ট, ট্রান্সপোর্ট কর্মচারী ও সাধারণ পথচারীরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। প্রায় ৩ ঘন্টা বন্ধ থাকে বেনাপোল-কলকাতা সড়ক। প্রাণের ভয়ে বন্দর ও আশেপাশের দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। পরে শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), নাভারন সার্কেলের এএসপি, শার্শা ও বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন।
এ ঘটনায় আজিজুর রহমান ও আলী হোসেনসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। আহতরা মেয়রের সমর্থক, তাদের বোমা হামলার সাথে জড়িত সন্দেহে মারপিট করে শ্রমিকরা। আহতদের দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ ২ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো, বেনাপোল পোর্ট থানার খড়িডাঙ্গা গ্রামের ইউসুফ আলী মোড়লের ছেলে আবুল কালাম (৪৮), একই থানার ছোট আঁচড়া গ্রামের সানার আলীর ছেলে আনসার আলী (৫০)।
বোমা হামলার প্রতিবাদে সকাল ১১টা থেকে বন্দরে আমদানিকৃত পণ্যচালান লোড-আনলোড বন্ধ রেখে শ্রমিকরা বেনাপোল বন্দরসহ বাজারে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করে। বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা মেয়রের অফিস, মার্কেটে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করেছে। কাস্টমস অফিসের সামনে মেয়রের ৫ তলা ভবনের নীচে অবস্থিত আইসিবি ব্যাংকের বুথসহ ভবনের সামনের গ্লাস ভাংচুর করা হয়। এতে ১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দলীয় প্রভাব বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন ও বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। বর্তমানে বন্দরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন- এমপি সমর্থক বেনাপোল বন্দরের ৯২৫ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রাজু আহম্মেদ এবং সম্পাদক উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সদস্য অহিদুজ্জামান অহিদ। মেয়র গ্রুপের সমর্থিত সাবেক হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক পৌর কমিশনার রাশেদ আলীর লোকজন বোমা হামলা চালিয়ে বন্দরের হ্যান্ডলিং কাজ দখল করতে সোমবার এ ঘটনা ঘটায় বলে শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের অভিযোগ।
৯২৫ শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক অহিদুজ্জামান অহিদ জানান, বর্তমানে শ্রমিকরা বন্দরে শান্তির সাথে কাজ করে আসছে। কিন্তু একটি পক্ষ তা ভালভাবে না নিয়ে, ষড়যন্ত্র করে বন্দরের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করতে চাইছে। এদিন মেয়র সমর্থিতরা হঠাৎ শ্রমিকদের উপর বোমা হামলা করে। পরে আমরা প্রতিহত করলে সন্ত্রাসীরা পিছু হটে।
যশোরের নাভারন সার্কেল এএসপি জুয়েল ইমরান জানান, বন্দরে দুটি শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেখানে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সংবাদ পেয়ে উপজেলা প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আহত অবস্থায় ২ জনকে আটক করা হয়েছে। জড়িত থাকার অভিযোগে বেনাপোল পৌর কমিশনার রাশেদ আলী নামও সামনে এসেছে। জড়িতদের আটক করে আইনের আওতায় আনা হবে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক মামুন কবীর তরফদার জানান, হ্যান্ডলিং শ্রমিকদের সৃষ্ট গোলযোগের কারণে সকাল ১১টা থেকে বন্দরে লোড-আনলোড কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে বন্দরে জটের সৃষ্টি হয়েছে।
এ ঘটনায় বন্দর এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য লোড-আনলোড এখনো বন্ধ। শ্রমিকরা বন্দরের সামনে অবস্থান নিয়েছে। তবে আজ (সোমবার) তারা কাজে যোগ দিবে না বলে জানিয়েছে কয়েকজন শ্রমিক নেতা।
বেনাপোল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন জানান, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি অহিদুজ্জামান ৩ বছর আগে বোমাবাজি করে অবৈধভাবে শ্রমিক ইউনিয়ন দখল করে আছে। এরপর তিনি সাধারণ শ্রমিকদের সদস্যপদ থেকে বাদ দিতে শুরু করেন। গতকাল বঞ্চিত শ্রমিকদের গ্রুপ ও অহিদুজ্জামান গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। অথচ সন্ত্রাসীরা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন এসব সন্ত্রাসী শ্রমিকদের মদদ দিচ্ছেন।
এব্যাপারে সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এমপি গ্রুপের রাজনীতি করেন শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হক মঞ্জু জানান, মেয়র আশরাফুল আলম লিটন মিথ্যা মামলা করে অবৈধভাবে বেনাপোল পৌরসভার মেয়র হিসেবে রয়েছেন। তার ক্যাডার বাহিনী কাউন্সিলর রাশেদ আলীর নেতৃত্বে গতকাল সকালে মাইক্রোবাসে এসে শ্রমিকদের পোশাক পরে বন্দরের দখল নিতে বোমবাজি শুরু করে। পরে সাধারণ শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে বের করে দেয়। শেয়র লিটন শান্ত বন্দরটিকে অশান্ত করে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।