মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বাঘটি
আয়েশি ভঙ্গিতে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বাঘটি দেখেই চমকে উঠেছিলেন পর্যটকরা। ভাবতেই পারেননি বাঘ বসে আছে বাইন গাছের ডালে। ৫-১০ মিনিট শুধু ভেবেছেন, আসলেই কি আমরা বাঘের দেখা পেয়েছি? এরপর টানা ঘণ্টাখানেক বাঘের আশপাশে ঘুরেছে আর ছবি তুলেছে এই পর্যটক দলটি। সুন্দরবন ভ্রমণের একশবারে বাঘের দেখা পাওয়া সেই সময়ের অনুভূতি ও ঘটনা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন আর্টিস্ট ফরিদি নোমান।
ফরিদি নোমান গোপালগঞ্জ জেলার সুকতাইল গ্রামের বাসিন্দা। বাবা প্রফেসর মনিরুজ্জামান ফরিদি। সুকতাইলে গ্রামের বাড়ি হলেও বাবা বাড়ি করেছেন ফরিদপুরে। ফরিদি নোমান থাকেন রাজধানী ঢাকায়। আগে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন রাজধানীতে আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন তিনি।
সুন্দরবন ভ্রমণ শুরুর গল্প জানিয়ে ফরিদি নোমান জানান, ২০০৪-০৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রোগ্রাম থেকেই সুন্দরবনে যাওয়া শুরু। এরপর থেকেই সুন্দরবনের পেছনে ঘোরাঘুরি। বাঘ মামা ছিলেন কামাল ভাই, তিনি আমাকে উৎসাহ দিতেন। পাশাপাশি আরও অনেকেই ছিলেন। করোনার আগে প্রতি বছরে ৬-৭ বার সুন্দরবন ভ্রমণ করেছি। এ পর্যন্ত সবমিলিয়ে একশবার সুন্দরবনে গিয়েছি। আমি মূলত ভিডিও করার জন্য যেতাম। এবার পাখির ফটোগ্রাফির জন্য গিয়েছিলাম। পাখির ওপর কাজ করি। ভেবেছিলাম পাখির ফটোগ্রাফি করবো।
কোথায় দেখা পেলেন বাঘটির
৩১ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পূর্ব সুন্দরবনে এলাকায় বাঘের দেখা পেয়েছি আমরা। তবে দুটি কারণে সঠিক লোকেশন জানাচ্ছি না। কারণ দুটি হলো, বাঘটি ম্যাচিউরড না। অল্প বয়সি বাঘ মনে হয়েছে। সঠিক লোকেশান প্রচার হলে অন্যরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে, বাঘকে উত্যক্ত করবে। আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে, অনেক চোরা শিকারি থাকে যারা সুন্দরবনের বাঘ শিকার করার ধান্দায় থাকে। সঠিক লোকেশন প্রচার হলে বাঘটি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। সে কারণে বন বিভাগও অনুরোধ জানিয়েছে সঠিক জায়গাটি প্রচার না করতে। বাঘটির দেখা পেয়েছি পূর্ব সুন্দরবন এলাকায়।
যেভাবে বাঘের দেখা পেলেন
সকালের দিকে সুন্দরবনের জামতলা এলাকায় পাখি নিয়ে কাজ করেছি। একটি অজগরের বাসাও দেখে এসেছি। প্রচণ্ড গরমে আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। লঞ্চে এসে ভেবেছিলাম কটকা অফিস এলাকায় ঘোরাঘুরি করব। তখন খুব রোলিং হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ১০-১৫ কিলোমিটার ভাটায় চলে যায়। দুইজন সিনিয়র সদস্য তারাও সাংবাদিক অনিহা প্রকাশ করলেন, আর দরকার নেই। হাঁটাহাটির পক্ষে যাচ্ছিল না। এছাড়া লঞ্চে তেলের সংকট ছিল। এরপর বোট নামালাম। একটা খালে গেলাম। পাখি দেখলাম।
বাঘের দেখা পাওয়ার তো আশাই করিনি। আমরা বাঘ দেখতে পাব। তবে বাঘ দেখার আশা তো ছিলই। এটি ছিল আমাদের ভ্রমণের তৃতীয় দিন। বাঘের দেখা না পেয়ে হতাশ হলাম। ভেবেছিলাম, এবারও হচ্ছে না। তখন আরেকটি খালে গেলাম সেখানে পানি কম ছিল। নৌকা ঢুকানোর মতো অবস্থা না সেখানে। হঠাৎই বাইন গাছের ডালের উপর হলুদ কিছু একটা দেখতে পাই। প্রথমে বিশ্বাসই করিনি ওটা বাঘ ছিল।
বাঘ দেখার পর অনুভূতি কেমন ছিল
আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। সাধারণত বাঘকে গাছে দেখা দূর্লভ। শ্বাসমূলের মধ্যে, পানির মধ্যে বা জঙ্গলের মধ্যে বাঘ দেখা যায়। তবে গাছের ডালে এটা দেখা দুর্লভ ব্যাপার। আর এই দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা। আমাদের নৌকা প্রায় গাছের নিচ দিয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ আমরা চমকে গেলাম।
বাঘ এটা চিন্তা করতেও সময় লেগেছে। মাথা কাজ করছিল না। গাইড চিৎকার করে উঠল, বাঘ, বাঘ! সবাই বনের ভিতরে এখানে-সেখানে নজর দিচ্ছিল। কিন্তু বাঘটি বসে ছিল গাছের ডালে। গাছের ডালে বাঘ শুয়ে আছে সেটা বাকি সদস্যরা বুঝতেও কিছুটা সময় নিয়েছে। কয়েক মিনিট ছবি তুলছি কিন্তু জ্ঞান নেই।
উত্তেজনা যে এত ছিল আমরা বুঝতে পেরেছি ফিরে এসে। ৫-১০ মিনিট আমাদের কারো মাথা কাজ করেনি। অনেকটা বেহুঁশ অবস্থায় ছবি তুলেছি। আমাদের নৌকার খুব কাছেই ছিল। আমাদের দেখে নড়েচড়ে বসল বাঘটি। লাফ দিয়ে নৌকায় এসে পড়তে পারে ভেবে দ্রুত নৌকা সরিয়ে নিলাম। সরিয়ে দেখি আবার ডালে বসে পড়ছে। গাছের আরেকটা ডালকে বালিশ বানিয়ে নিয়েছে। মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমরা ৫০ বার নৌকা দিয়ে আশপাশে ঘুরেছি, ছবি তুলেছি। ভিডিও করেছি প্রায় ঘণ্টাখানেক। এরপর ফিরে আসি।
বন বিভাগ থেকে চার দিনের অনুমতিপত্র নিয়ে ফরিদি নোমাদের নয়জনের পর্যটক দলটি বাগেরহাট জেলার মংলা এলাকা দিয়ে সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশ করেন। দলে ছিলেন সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ নয়জন। একজন ছিলেন বন বিভাগের গাইড। নয়জনের সঙ্গে একজন এই প্রথমবার সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। আর প্রথমবারই দেখা পেয়েছেন সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।
খুলনা বিভাগের বন সংরক্ষক দপ্তরের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সাম্প্রতি সময়ে সুন্দরবন ভ্রমণের সময় বেশ কয়েকটি বাঘের দেখা পেয়েছেন পর্যটকরা। প্রথমে একটা, তারপর চারটা ও গত পরশু একটা দেখা পেয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন পর্যটক দল। এছাড়া বন বিভাগের কর্মীরাও বাঘের দেখা পাচ্ছেন। বাঘ দেখা যাচ্ছে পূর্ব বন বিভাগ এলাকায়। খুলনা অঞ্চলের পশ্চিম বন বিভাগে দেখা যায়নি এখনো।
সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে কি না—এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'সুন্দরবনে বাঘ বাড়ছে না কমছে সেটা জরিপে শেষ হলেই বলা যাবে। বছরের শেষ নাগাদ জরিপ শেষ হবে, তখন বলা যাবে। সবশেষ ২০১৮ সালের জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টা বাঘ ছিল।'