বাংলাদেশ আরেকটা শ্রীলঙ্কা হবে না: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বৈদেশিক ঋণের ব্যবস্থাপনা করছে। এ কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে নেই। শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশের সফট লোনের (যে ঋণের সুদহার অত্যন্ত কম) পরিমাণ অনেক বেশি, আর ম্যাচিউরিটি পিরিয়ডও (ঋণের চূড়ান্ত কিস্তি পরিশোধের তারিখ) বেশি।
এছাড়াও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এবং রপ্তানির পরিমাণ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সমষ্টির চেয়ে বড়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও দক্ষিণ এশিয়ার এ দুটি দেশের রিজার্ভের সমষ্টির দ্বিগুণ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। আইএমএফের বেইলআউটের আওতায় রয়েছে পাকিস্তান। এই পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সক্ষমতা ও টেকসইতার অবস্থা জানাতে গিয়ে এসব তথ্য দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও)।
শ্রীলঙ্কা সাময়িকভাবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বন্ধ রাখবে বলে জানিয়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। তার এ বক্তব্যে বাংলাদেশ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় যে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিল, তা আদায় নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র আর্থিক আমলারা গতকাল দেশের সামগ্রিক বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আর্থিক অবস্থা সবিস্তারে উপস্থাপন করেন।
বৈদেশিক ঋণসহ দেশের অর্থনৈতিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের এমন বিশ্লেষণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, রাজস্ব আদায়, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমলারা। তারা বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী অবস্থান ছাড়াও রাজস্ব ছাড় ও আদায়ের ক্ষেত্রেও ঢাকার সঙ্গে তুলনা হয় না ঋণগ্রস্ত হয়ে দেউলিয়া হতে যাওয়া শ্রীলঙ্কার।
তিন ঘণ্টাব্যাপী এসব তথ্য বিশ্লেষণ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস।
'এর আগেও আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি যে, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের সামনে দীর্ঘমেয়াদে কোনো ঝূঁকি নেই। তবু তিনি সার্বিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আশ্বস্ত হয়েছেন,' জানান তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ার চার বৃহৎ অর্থনীতি ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে আহমেদ কায়কাউস বলেন, গত বছর যখন মহামারির মধ্যে ভারত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল তখন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের বেশি। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী।
'আগামী ৫-১০ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কোনো আশঙ্কা নেই,' উল্লেখ করে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, গত ৮ মাসে দেশের রাজস্ব আয়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, বেসরকারি খাতে ক্রেডিট প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ এবং রপ্তানিতেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ফলে কোনোভাবেই বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা যায় না বলে মন্তব্য করেন অর্থ সচিব।
বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে নেওয়া। এ ধরনের ঋণের সুদহার কম, গ্রেস পিরিয়ড ও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ হয়।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ ঋণ বাণিজ্যিক ও সার্বভৌম বন্ডে নেওয়া। এসব ঋণের সুদহার বেশি এবং পাঁচ বছরে সুদসহ পরিশোধ করতে হয়।
ফাতেমা ইয়াসমিন বলেন, 'অন্যদিকে, বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধকাল ৩০ বছর। বাংলাদেশের কোনো বাণিজ্যিক ও সার্বভৌম বন্ড নেই। শ্রীলঙ্কার ঋণের সুদহার ৮ শতাংশের বেশি হলেও বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের সুদহার ১.৪ শতাংশ।'
আগে থেকেই চাপের মধ্যে ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতি। এর মধ্যেই দেশটিতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা, সদ্যই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ইমরান খান। দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে এখন এমন এক টালমাটাল অর্থনীতি পরিচালনার ভার, যার ঘাটতি ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে চড়চড় করে, কমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং দুর্বল হয়ে আসছে রুপি। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই শাহবাজ শরিফ বর্তমান আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন এবং মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক নীতির পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি জাতীয় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনও টালমাটাল হয়ে ওঠে। যার জেরে দেখা দেয় মূল্যবৃদ্ধি এবং খাদ্য, তেল ও ওষুধ সংকট। এসবের জেরে দেশটির মন্ত্রীরা রীতিমতো গণপদত্যাগ করেন। বৈদেশিক ঋণ বাড়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত ঘোষণা করেছে।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। আর মুদ্রাস্ফীতির চাপ থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের মতো বাহ্যিক ফ্যাক্টরগুলো ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে পেরেছে।
এ প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময় দেশের আর্থিক অবস্থার খোঁজখবর নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনও ঝুঁকিসীমার অনেক নিচে রয়েছে। উপস্থাপনাটি শুনে প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে ঋণের বর্তমান এই অবস্থান ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
কয়েকদিন আগেই সংসদ বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বাংলাদেশের পরিণতি শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি শক্তিশালী স্তম্ভের চিত্র তুলে ধরে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, গত ১৩ বছরে ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে আরএমজি রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও ধান উৎপাদন বেড়েছে। সরকারের দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনার কারণে কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই তিন খাতের পাশাপাশি কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
অর্থসচিব বলেন, বাংলাদেশের জিডিপির আকার শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জিডিপির যোগফলের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণও এ দুই দেশের রপ্তানি আয়ের সমষ্টির চেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার রিজার্ভের সমষ্টির দ্বিগুণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবের তথ্যানুসারে, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং দেশটিকে প্রতি বছর ৭.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার হলেও প্রতি বছর পরিশোধ করতে হয় ২.৫ বিলিয়ন ডলার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বেশি নমনীয় ঋণের অর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করে। আর কম নমনীয় ঋণের অর্থ ব্যয় করে লাভজনক বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে, যেখান থেকে সরকার রাজস্ব আহরণ করে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, বাংলাদেশ কখনও চীনা ঋণের ফাঁদে পড়বে না।
'বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৭.৮ শতাংশ চীন থেকে নেওয়া। ভূরাজনৈতিক কারণেই এ ইস্যুটি বিভিন্ন সময় সামনে আনা হয়,' বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব আরও বলেন, 'আমরা কখনও চীনের উপর নির্ভরশীল ছিলাম না, এখনও নেই। আমরা বেছে বেছে চীনা অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণ করি। যে প্রকল্প নেওয়া লাভজনক বলে মনে হয়, শুধু সেখানেই চীনা অর্থায়ন নেওয়া হয়।'
তিনি বলেন, এক যুগ ধরে বাংলাদেশে 'হায় হায় রব' তৈরি করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যখন বিদ্যুৎ সংকট দূর করতে কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হলো, তখন থেকেই বলা শুরু হলো যে দেশ রসাতলে যাবে, কিন্তু যায়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার সময়ও একটি শ্রেণি একই রকম করেছে, কিন্তু সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করছে। যখনই বড় কোন প্রকল্প নেওয়া হয়, তখনই একটি শ্রেণি তার বিরোধীতা করে।
'স্বাধীন হলে বাংলাদেশ টিকবে না বলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই একটি পক্ষ সরব ছিল। তারা তখনও ভূল প্রমাণিত হয়েছে, তারা এখনও ভুল প্রমাণিত হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।
কায়কাউস বলেন, 'আমরা ভুল করতে পারি, পা পিছলে যেতে পারে; কিন্তু আমাদের গতিপথে কখনও পরিবর্তন আসেনি।'
'স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমরা যখন বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে গর্বিত ও উল্লসিত, তখন বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে জাতীয় অর্জনকে এভাবে অবদমন করলে তার চেয়ে লজ্জাকর ও হাস্যকর কিছু হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম জানান, অনেকেই এনবিআরের রাজস্ব ছাড় দেওয়াকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন যে, রাজস্ব ছাড় দেওয়ার কারণেই শ্রীলঙ্কার অবস্থা করুণ হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা শ্রীলঙ্কার মতো রাজস্ব ছাড় দিচ্ছি না। এনবিআর রাজস্ব সমন্বয় করছে। আমরা অন্ধের মতো রাজস্ব ছাড় দিচ্ছি না। যেখানে রাজস্ব ছাড় দিলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে এবং পরবর্তীতে আরও বেশি রাজস্ব আদায় হবে—সেখানে সতর্কতার সঙ্গে রাজস্ব ছাড় দিচ্ছে এনবিআর।'
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'একসময় রেডিও, টিভি, ফ্রিজ, এসিসহ ইলেক্ট্রনিকস আইটেম আমদানিনির্ভর ছিল। রাজস্ব ছাড় দেওয়ার কারণে এসব পণ্য এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে এবং দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে মেটানো হচ্ছে। এ খাত থেকে এখন ভিন্নভাবে বেশি রাজস্ব আয় হচ্ছে। কর ছাড় দেওয়ার কারণে দেশে এখন ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ফোর হুইলার উৎপাদনে বিনিয়োগ হচ্ছে।'
মূল্যস্ফীতি কমলে ভর্তুকি সমন্বয়
দেশের মূল্যস্ফীতির হার কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে না আসা পর্যন্ত ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার।
'ভর্তুকির চাপ থাকলেও এই মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করে মূল্যস্ফীতি বাড়াতে চাচ্ছে না সরকার। যখন মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, তখন সরকার আস্তে আস্তে ভর্তুকি সমন্বয় করবে,' জানান তিনি।
আহমদ কায়কাউস বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এমন কোনো চাপ আসবে না, যাতে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, দেশেও সেগুলোর দাম বেড়েছে। তবে সরকার এক কোটি দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ায় বাজারদর সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে।
তিনি আরও বলেন, 'যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লেও দেশে বাড়েনি। জ্বালানির দাম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতিদিন দাম বাড়তে থাকলে একসময় আমাদের সমন্বয় করতে হবে। তবে এখনও এ বিষয়ে কোনো চিন্তা করছি না।'
ব্যালেন্স অভ পেমেন্টে ঘাটতিকে 'তুচ্ছ' বিষয় উল্লেখ করে কায়কাউস বলেন, এসব বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোটেই উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলেন, 'আমাদের ব্যালেন্স অভ পেমেন্ট ঘাটতি বেড়েছে। কিন্তু আমাদের রিজার্ভ দিয়ে ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট গ্রোথ যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে রপ্তানি ও রিজার্ভ আরও বাড়বে।'
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা নিয়ে উদ্বেগ
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যখন বৈদেশিক মুদ্রার তলায়মান রিজার্ভের কারণে খাড়া পতনের শিকার হতে শুরু করে, তখন থেকেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের বোঝা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। কারণ দেশের অনেক মেগা-প্রকল্পই চলছে বিদেশি সহায়তায়।
গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অনুষ্ঠানেও শোনা যায় তেমন শঙ্কার প্রতিধ্বনি।
সিপিডির ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আমাদের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার সাথে তুলনীয় নয়। আমাদের তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে শ্রীলঙ্কা থেকে অবশ্যই শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই রয়েছে। আমাদের এখনকার পরিস্থিতি ভালো। তবে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা যেহেতু উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ করতে যাচ্ছি, তাই আমাদের বৈদেশিক ঋণের মঞ্জুরি অংশ আরও কমবে। আমাদের জন্য ছাড়কৃত ঋণও কমবে। তখন আমাদের প্রচলিত বাজারদরে বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে।'
শ্রীলঙ্কা আজ যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের উচিত সুশাসনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী উপায়ে এবং সঠিক সময়ে মেগা প্রকল্পগুলো শেষ করা, যোগ করেন তিনি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের বাহ্যিক খাত একসময় অর্থনীতির শক্তি ছিল, যা এখন বৈদেশিক বাণিজ্য, চলতি হিসাব ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে চাপের মুখে রয়েছে।
বিদেশি উৎস থেকে সরকারি ঋণ বাড়ছে এবং এ ধরনের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে তা বহিরাগত ঋণ পরিশোধের ব্যয়ে চাপ সৃষ্টি করবে বলে সতর্ক করেন তিনি। এবং উল্লেখ করেন, বাহ্যিক ব্যালান্সের সমস্ত উপাদান—বাণিজ্য, চলতি হিসাব ও সামগ্রিক অর্থনীতি—চাপের মধ্যে রয়েছে।
শ্রীলঙ্কাকে আরও সময় দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক
অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ। কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট আরও খারাপের দিকে যেতে শুরু করার পর থেকে এখন অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এক ঘোষণায় জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কা অস্থায়ীভাবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত করবে—যা আরও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশের দেওয়া ঋণের ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের ১৮ মে শ্রীলঙ্কার ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার কথা। অবশিষ্ট অর্থ দুই কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা। এ বছরের ৩১ মে ১০০ মিলিয়ন এবং ১২ জুন বাকি ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের কথা ছিল।
'কিন্তু যেহেতু দেশটি খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাই কলম্বো আনুষ্ঠানিকভাবে সময় চাইলে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে,' তিনি যোগ করেন।
এর আগে গত বছরের ১৮ আগস্ট শ্রীলঙ্কাকে ৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয় বাংলাদেশ। কলম্বোকে এরপর এক দফায় ১০০ মিলিয়ন ও সবশেষ ৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ঢাকা।
ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে শ্রীলঙ্কাকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। সুদহার ছিল লিবর+২ শতাংশ। লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফার্ড রেট (লিবর) হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেওয়ার জন্য প্রচলিত সুদের হার।
প্রথম কিস্তির ঋণ শোধ করতে না পারায় শ্রীলঙ্কাকে আরও তিন মাস সময় দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়বারের তিন মাসেও সুদের হার সমান রাখা হয়। তবে নতুন করে দেশটিকে ছয় মাস মাসের সময় দেয়া হয়েছে। ছয় মাসের বর্ধিত সময়ে সুদহার লিবর+২.৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি নতুন করে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।