মধ্যস্বত্বভোগী নেই তো রোগীও নেই: সাভারের বেসরকারি হাসপাতালে দালালদের রাজত্ব
আয়েশা আক্তার (ছদ্মনাম) রাজধানীর পর্শ্ববর্তী উপজেলা সাভারের পৌর এলাকার একজন বাসিন্দা, সম্প্রতি শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে শরণাপন্ন হয়েছিলেন স্থানীয় একজন ফার্মেসি ব্যবসায়ীর, পরে সেই তার পরামর্শে চিকিৎসা নিতে যান সাভার প্রাইম হাসপাতালে। সেখানে বিভিন্ন টেস্ট করাতে তার বড় অঙ্কের খরচ হয়।
কিন্তু ঘুর্নাক্ষরেও জানতে পারেননি হাসপাতালে তার বিভিন্ন শারীরিক পরিক্ষা নিরিক্ষা বাবদ খরচকৃত প্রায় ৯ হাজার টাকার একটা বড় অংশই গিয়েছে ফয়সাল নামে সেই ফার্মেসি মালিকের পকেটে।
সাভারের নামাবাজার এলাকার ফার্মেসির মালিক ফয়সাল আহমেদ স্বীকার করেন তিনি একজন মধ্যস্বত্বভোগী। তিনি বলেন, কমিশন নেওয়াকে ভুল মনে করেন না তিনি।
"হাসপাতালে রোগী পাঠানোর জন্য আমি কোনো কমিশন না নিলেও রোগীদের একই খরচ বহন করতে হবে। বরং আমার মাধ্যমে রোগীরা কিছু ছাড় পান, আমিও কিছু উপার্জন করতে পারি। এছাড়া আমি যে কমিশন পাই তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লাভের একটি অংশ। আমাকে কমিশন না দিলে তা হাসপাতালের লাভের সঙ্গে যোগ হতো," বলেন ফয়সাল।
তিনি আরও বলেন, অনেক চিকিৎসক কমিশন নিচ্ছেন, তাই তিনিও এটা রায় তাতে দোষের কিছু নেই।
"চিকিৎসকরা হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পান, যেখানে তাদের রোগীরা চিকিৎসা পরীক্ষার জন্য যান। আবার, চিকিত্সকরা তাদের ওষুধের প্রেসক্রিপশনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছ থেকে উপহার এবং কমিশনও পান," যোগ করেন তিনি।
তবে এ ধরনের কমিশন নেওয়ার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকদের নাম প্রকাশ করেননি তিনি।
শুধু সাভার প্রাইম হাসপাতালই নয়, উপজেলায় অবস্থিত অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারই নির্ভরশীল এই দালাল চক্রের হাতে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক হাসপাতালের মালিক ও ব্যবস্থাপকরা জানান, দালালদের কমিশন দেওয়া বন্ধ করে দিলে ফলে তাদের প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দেওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
সাভারের গেন্ডা এলাকায় অবিস্থিত নিউ লাইফ কেয়ার হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ জানান, ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে তারা দালালদের ২০ শতাংশ কমিশন দেন, আর বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিক্ষার ক্ষেত্রে তা আরও বেশি হয়, বিভিন্ন পরী ক্ষার ক্ষেত্রে এই কমিশন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়।
বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রণহীন এই বাস্তবতার কথা স্বীকার করে প্রাইভেট হসপিটাল অনার্স এসোসিয়েশন অব সাভারের (ফোয়াস) সাধারণ সম্পাদক ও ল্যাব জোন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মো. ওয়াকিলুর রহমান জানান, তাদের হিসাব বলছে প্রতি মাসে শুধু তাদের অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত ৪০ টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে গড়ে অন্তত ৫ লক্ষ টাকা কমিশন বাবদ এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের পকেটে যাচ্ছে।
ওয়াকিলুর রহমান জানান, কয়েক দফায় তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এই কমিশন কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও চূড়ান্তভাবে কখনোই সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
"দেখুন, সারাদেশেই মধ্যস্বত্বভোগীদের কমিশন দেওয়া হয়। শুধুমাত্র আমার সংস্থা এটি বন্ধ করে, তবে এটি কাজ করবে না। তখন এই দালালরা রোগীদের আমার হাসপাতালে পাঠানোর পরিবর্তে অন্য হাসপাতালে পাঠাবে। তাদের কাছে মানসম্মত চিকিৎসা বড় বিষয় নয়। কে বেশি কমিশন দিতে পারে তা নিয়েই প্রতিযোগিতা চলে। উপজেলায় অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকায় তাদের মধ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে," বলেন ওয়াকিলুর।
কীভাবে হাসপাতাল মালিক বা সংগঠনের নেতারা স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ চিকিৎসা সেবার বিভিন্ন মূল্য নির্ধারণ করেন জানতে চাইলে ওয়াকিলুর রহমান জানান, মূলত ঢাকার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তারা এই মূল্য নির্ধারণ করেছেন,কেননা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোন মূল নির্ধারন করে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের সেবামূল্যের পাশাপাশি দালালদের কমিশনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয় বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সাভারেই এই দালালদের সংখ্যা অন্তত ৫ হাজার, যার বড় একটি অংশই ফার্মেসি ব্যবসায়ী। এছাড়াও এই দালালি পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ।
ওয়াকিলুর রহমান জানান, শুধু এই কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করা গেলে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব, এছাড়াও এই দালালদের কারণে অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বিভিন্ন নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রতারিতও হন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সাভার উপজেলায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে ৫৪টি। এছাড়াও, ৭১টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে যার বেশিরভাগই বিভিন্ন হাসপাতালের অংশ।
অন্যদিকে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও অবৈধসহ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দেড় শতাধিক বলে জানিয়েছে সাভারের বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতি।
সাভার উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মোঃ মোজাম্মেল হক জানান, উপজেলায় শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক বছর আগে করা জরিপের ভিত্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।
কিছু নতুন হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলেছে এবং কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কোভিড-১৯ মহামাড়ী চলাকালীন বিভিন্ন জটিলতার কারণে এই তালিকা আপডেট করা হয়নি বলে জানান মোজাম্মেল।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মো. আরমান জানান, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও আমিনবাজার ও বিরুলিয়ায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুটি উপকেন্দ্র আছে। এছাড়াও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২০,০০০ বহিরাগত রোগী আসে, ভর্তি হয় ৫ হাজার। কমিউনিটি ক্লিনিক এবং প্রতি মাসে দুটি উপ-কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যাও ৩০ হাজারের কম নয়।
তবে কতজন রোগী বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নেন তার কোনো তথ্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে নেই। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সাভারের জনসংখ্যা ১৪,৪২,৮৮৫।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আব্দুস সবুর বলেন, এই খাতকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দেশে চিকিৎসা ব্যয় ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।
"ঢাকায় যদি সিজারিয়ান সেকশন করতে যান, দেখবেন হাসপাতাল ভেদে খরচ বিভিন্ন। কোনো হাসপাতালে ১০ হাজার টাকায় সিজারিয়ান অপারেশন হচ্ছে, আবার একই শহরে সেই খরচ গিয়ে দাড়াচ্ছে দেড় লক্ষ টাকায়। এটা সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত এক খাত।"
তিনি বলেন, এই খাতকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার একটি কারণ দেশে বিদ্যমান প্রাইভেট হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট আইন এত বেশি পুরোনো এটা বর্তমান সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও আইনটি বিভিন্ন কারনে আর সংশোধন করা যায়নি।
এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনবল সংকট তো আছেই, বলেন তিনি।
"এ কারণে এই খাত এখন সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে, কোনো জবাবদিহিতা নেই। শুধু এই কারণেই দেশের বহু মানুষ আকাশচুম্বী এই চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ ও মধ্যস্বত্বভোগীরা।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. ফরিদ হোসাইন মিয়া জানান, দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন তৈরি হচ্ছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন আইনটি তৈরি হয়ে গেলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটিতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
"প্রতিষ্ঠান ও সেবাগুলোকে ক্যাটাগরীক্যালী ভাগ করা, মূল্য নির্ধারণ করার মত কিছু বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই সেটি বাস্তবায়ন করা যাবে, আর এটা বাস্তবায়ন করা গেলে আইনের যেই দুর্বলতা এখন রয়েছে, সেটি সমাধানের পাশাপাশি পুরো খাতটিকে একটা নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা যাবে।"