উদাসীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে সুনীলের স্মৃতিচিহ্ন, বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন
দুই রুমের নিস্তব্ধ একটি ছোট পাকা বাড়ি, সামনে একটি একচালা টিন দিয়ে বানোনো বারান্দা। বাড়ির উঠোনে জমে আছে শুকনো পাতা। একটু এগোনোর পরে চোখে পড়লো মরিচা পড়া তালাবদ্ধ ঘর। ঘরের বারান্দায় রাখা আছে পাটখড়ি। বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কারণে বিচ্ছিন্ন আছে বিদ্যুৎ সংযোগ।
দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে থাকায় জানালার গ্রিলে বাসা বেধেছে মাকড়সা। ঘরের একরুমে পড়ে আছে একটি ধুলাবালির আস্তর পড়া জীর্ণশীর্ণ খাট। দুটি তেলচিটচিটে বালিশ ও পুরোনো নষ্ট হয়ে যাওয়া তোষক।
এমনই দৃশ্য দেখা গেছে মাদারীপুরের মাইজপাড়া গ্রামে সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৈত্রিক ভিটায়।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সুনীলের স্মৃতিচিহ্ন তার পৈত্রিক ভিটা ও তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র।
উপজেলা প্রশসান বলছে স্থানীয় কমিটি দেখভাল করবে। আর স্থানীয় কমিটি বলছে সব দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসন নিলেও কোনো প্রকার দেখভালের কাজ করছে না।
বাড়িটির বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছে উপজেলা প্রশাসনের নামে, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্থানীয় কমিটির সদস্য বিপ্লব হাওলাদার বলেন, "কবির বাড়িসহ সকল কিছু দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার, এমনকি এই বাড়ীর বিদ্যুৎ সংযোগ তার নামে কিন্তু কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না উপজেলা প্রশাসন।"
মাদারীপুর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কালকিনি জোনাল অফিসের ডিজিএম আব্দুল মাজেদ বলেন, "আমরা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বকেয়া বিল পরিশোধ করার কথা জানিয়েছিলাম।"
কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিপংকর তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, "সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত পৈত্রিকভিটা সংরক্ষণ করার জন্য কমিটি আছে। উপজেলা প্রশাসনের এর সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যখন মেলা হয়েছিলো আমাদের উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছিলো। এখন কী অবস্থায় আছে তা জানি না।"
কবির বাড়িতে গিয়ে প্রতিবেদক দেখতে পান, ঘরের ভেতরে দেয়ালে কবির ঝুলছে কবির পরিবারের সাথে একটি পুরনো ছবি। তার পাশেই ড. রোজমারি হেলফেরিখের একটি ছবি। পাশের রুমে আছে একটি পুরোনো কাঠের আলমারি, ঘুণ পোকা খেয়ে ইতোমধ্যে যায় যায় অবস্থা। আলমারিটিতে আছে কবির লেখা বেশ কিছু বই, উপন্যাস ও কবির ব্যবহৃত কিছু স্মৃতিচিহ্ন, এর অধিকাংশই সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভারতে থাকাকালীন সময়ে তার পৈত্রিক বাড়ি বেদখল হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২ হাজার সালের প্রথম দিকে মাইজপাড়া গ্রামের আমেরিকা প্রবাসী আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটা খুঁজে বের করেন। সেসময় কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সহযোগিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৭ একর ১৫ শতাংশ জমি দখল মুক্ত করে একটি পাঠাগার তৈরি করেন।
এরপর থেকে প্রতিবছর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনে তার পৈত্রিক বাড়ি মাইজপাড়ায় 'সুনীল মেলা' অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০১০ সালের ১৭ নভেম্বর সেখানে এসেছিলেন। করোনার কারণে তার পৈত্রিক ভিটায় আর সুনীল মেলা আর হয়নি। এরপর থেকেই অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে তার পৈত্রিক বাড়ি ও কবির ব্যবহৃত স্মৃতি চিহ্নগুলো।
স্থানীয় ইউসুফ কাজী বলেন, "এখানে মেলা হতো কিন্তু করোনার পরে আর হয়নি। সরকারিভাবে কেউ দেখাশোনা করে না। পুনরায় সরকারিভাবে এই স্থানটির দেখাশোনা করা হোক যাতে কবির স্মৃতি চিহ্নগুলো সংরক্ষণ করা যায়।"