সন্দ্বীপ নৌ-রুট: জীবন যেখানে মূল্যহীন, প্রশাসন ‘প্যারালাইজড’
বুধবার ওমান প্রবাসী বাবাকে বিদায় দিয়ে মায়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহর থেকে সন্দ্বীপে ফিরছিলেন আনিকা (১২), আদিফা (৮) ও আলিভা (৮)। সন্দ্বীপ চ্যানেলে অবৈধভাবে পরিচালিত একটি স্পিড বোট ডুবির ঘটনায় প্রাণ গেছে শিশু আনিকার। একসঙ্গে সাগরে ভেসে গেছে জমজ বোন আদিফা ও আলিভা। নিখোঁজ রয়েছে আরেক শিশু সৈকত। এই মর্মান্তিক ঘটনা স্তব্দ করে দিয়েছে দ্বীপ-জনপদ সন্দ্বীপকে।
এই একবার নয়, সমন্বয়হীনভাবে পরিচালিত কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ রুটে প্রায় ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। এর আগে ২০১৭ সালে এই নৌ-পথে বোট ডুবে ১৮ যাত্রীর সলিল সমাধি হয়।
মেঘনা নদীর মোহনায় ঐতিহ্যঘেরা প্রাচীন দ্বীপ জনপদ সন্দ্বীপ। প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস এখানে। দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে এ দ্বীপের বাসিন্দাদের যোগাযোগের একমাত্র পথ সন্দ্বীপ চ্যানেল। কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ রুট থেকে বছরে আয় সাড়ে তিন কোটি টাকা, সে রাজস্বে কে ভাগ বসাবে এই নিয়ে দ্বন্দ্ব সরকারি দুই সংস্থার। তাদের সমন্বয়হীন পদক্ষেপের বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
পিতাকে বিদায় দিয়ে না ফেরার দেশে তিন বোন
তিন মেয়েকে হারিয়ে বেঁচে ফিরেছেন মা পান্না। তিনি জানান, সকাল সাড়ে আটটায় কুমিরা ঘাট থেকে তারা বাইশজন স্পিড বোটে যাত্রা করেন। বোটে উঠার পর সবাইকে লাইফ জ্যাকেট দিলেও বরাবরের মতো কোনো জ্যাকেট দেওয়া হয়নি শিশুদেরকে। মাঝপথ পাড়ি দেওয়ার পর থেকে হঠাৎ বাতাস শুরু হয়। সন্দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছার আগেই বাতাস বাড়তে থাকে। এসময় বিপদ দেখে বোটচালক যাত্রীদের রেখে কিনারায় নেমে যায়, যাত্রীদের মাঝে আতংক সৃষ্টি হয়। জীবন বাঁচাতে যাত্রীরাও বোট থেকে ঝাঁপ দেন।
পান্না বলেন, 'আমরা একসাথেই ছিলাম স্পিডবোটে। এখন ওরা কেউ নেই। আমার মেয়েদের লাশটা হলেও এনে দেন।'
প্রশাসন যেখানে প্যারালাইজড
বুধবারের মর্মান্তিক ঘটনার এক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সন্দ্বীপ নৌ রুটে অবৈধভাবে পরিচালিত স্পিড বোট বন্ধ করতে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু জেলা প্রশাসনের সেই নির্দেশনা এক সপ্তাহেও বাস্তবায়ন করেননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীশা।
বুধবার অবৈধভাবে পরিচালিত স্পিড বোট ডুবিতে তিনবোনসহ চার শিশুর সলিল সমাধি হলেও গত ২৪ ঘন্টায় (দুপুর ১২ টা) কাউকে গ্রেপ্তার করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উল্টো বুধবার বিকেলে অবৈধভাবে স্পিড বোট পরিচালনাকারী গুপ্তছড়া ঘাটের ইজারাদার এস. এম আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে ঘুরতে দেখা গেছে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীশাকে। ইউএনওর এমন কর্মকান্ডে বিস্মিত সন্দ্বীপবাসী। দুর্ঘটনার দায়ে যাকে গ্রেপ্তার করার কথা সেই ইজারাদারের সঙ্গে ইউএনওর শোডাউনের ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।
সন্দ্বীপ (চট্টগ্রাম-৩) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) মাহফুজুর রহমান মিতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইউএনওর কাণ্ডে আমরা হতবাক। জেলা প্রশাসনের আদেশতো বাস্তবায়ন করেনইনি, উল্টো অবৈধ ইজারাদারকে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি!'
দশ বছর আগেও শ্রমিকদের মাঝি হিসেবে কাজ করা আনোয়ার মাঝি এখন এস. এম আনোয়ার হোসেন নামে পরিচিত। টাকার জোড়ে সন্দ্বীপের রাজনীতি ও প্রশাসনের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশ সম্পাদক আনোয়ার বর্তমানে সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। মূলত জেলা পরিষদের কর্তাদের মুঠোয় নিয়ে তিনি জিম্মি করেছেন সন্দ্বীপের সাড়ে চার লাখ মানুষকে। তবে জানতে চাইলে এসবের সবই অস্বীকার করেছেন আনোয়ার হোসেন।
চট্টগ্রামের সাংবাদিক সালেহ নোমান বলেন, 'কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ রুটে পরিচালিত বোটগুলোর লাইসেন্স নেই, ড্রাইভারদের লাইসেন্স নেই। ইজারাদার খেয়াল-খুশিমতো ভাড়া বাড়ায়। কিন্তু এসব নিয়ে আর মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা রহস্যজনক। এখানে টাকার কাছে সব বিক্রি হয়ে গেছে।'
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীশা টিবিএসকে বলেন, 'এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা নেব।'
এ বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সংযোগ স্থাপন করা যায়নি।
দুই সংস্থার দ্বন্দ্বে সাড়ে চার লাখ মানুষের দুর্ভোগ
চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপের নৌরুটে থাকা কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটটির মালিক কাগজে-কলমে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর বিআইডব্লিউটিএ মো. আবুল কাশেমের নামে একজনের অনুকূলে ঘাট ইজারা প্রদান করে। ওই ইজারাদার কাজ শুরুর একদিন আগে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন একজনকে নৌ ঘাটটি ইজারা দিয়ে দেয়।
সেই থেকে দুর্ভোগের শুরু দ্বীপটির বাসিন্দাদের। ঘাট নিয়ে সরকারি সংস্থা দুটির দ্বন্দ্বের জেড়ে গত ৯ বছরে এই রুটে গড়ে ওঠেনি যুগোপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো। জেলা পরিষদ ২০১৪ সাল থেকে ঘাটটি পরিচালনা করলেও এই রুটে নেই কোনো নিরাপদ নৌযান। জোয়ারের সময় নদীর পানিতে নেমে কিংবা ভাটার সময় কাদায় হেঁটে নৌ-যানে উঠতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা। জেলা পরিষদ উচ্চহারে ইজারা দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ লাখ টাকা রাজস্ব নিচ্ছে। অপরদিকে রাজস্ব হারিয়ে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ সত্ত্বেও সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসছে না বিআইডব্লিউটিএ। অথচ টার্মিনাল ও গ্যাংওয়ে ব্যবহার বাবদ বছরে ৪০ লাখ টাকা করে আদায় করছে জেলা পরিষদ থেকে।
২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর ছয় বছরের সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু জেলা পরিষদ এখনো বিআইডব্লিউটিএকে ঘাট বুঝিয়ে না দিয়ে অবৈধ ইজারাদার দিয়ে ঘাট পরিচালনা করছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবু রাইহান তানিন টিবিএসকে বলেন, 'আমার মনে হয় এই সমস্য জিইয়ে রাখার পেছনে বিআইডব্লিউটির কিছু অসাধু কর্মকর্তার হাত আছে। তারপরও চাই কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটটিতে বিআইডব্লিউটি পরিচালনা করুক। কারণ তাদের জাহাজ আছে। এছাড়া ঘাট পরিচালনা ও দুর্ঘটনা রোধে দক্ষতা রয়েছে। অবৈধ বোট বন্ধ করে অন্তত দুটি সি-ট্রাক চালু করলে সন্দ্বীপ নৌ রুটটি মোটামুটি নিরাপদ হবে।'
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০২০ সালের ১ মার্চ সরকার চট্টগ্রাম উপকূলের মুহুরী প্রজেক্ট থেকে রাসমনি ঘাট পর্যন্ত এলাকাকে নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা করে। এই নদীবন্দরের সংরক্ষক হিসেবে বিআইডব্লিউটিএকে নিযুক্ত করেছে। জেলা পরিষদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এ ঘাটের উন্নয়নে মেগা পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘাটের মালিকানা বিআইডব্লিউটিএর কাছে না এলে নিরাপদ ও আধুনিক নৌ-রুট বাস্তবায়নের কাজ অধরাই থেকে যাবে।'
তবে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির ইকবাল জানান, ঘাটের মালিকানা নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে তাদের সমঝোতা চুক্তি আছে।
'এই ঘাটে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ আছে। এরমধ্যে একাধিক প্রকল্প চলমান আছে এখনো। এখন এটি কিভাবে পরিচালিত হবে তা মন্ত্রণালয়ই ঠিক করবে,' বলেন তিনি।
সন্দ্বীপের এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সমস্যা সমাধানে একটি কমিটি গঠন করেছে। আশা করছি শিগগিরই সমাধান হবে।'