ঈদ ছুটি শেষে ফিরতে পথে পথে ভোগান্তি যাত্রীদের
ঈদের ছুটি শেষে জীবন–জীবিকার তাগিদে রাজধানীর কর্মস্থলে ফিরতে পথে পথে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। গণপরিবহনসহ দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ, ট্রেনে যাত্রীদের চাপ বাড়ায় রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশমুখ ও টার্মিনালে এখন ঢাকামুখী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। ফেরিঘাটের যানজটে অনেককে আটকে থাকতে হচ্ছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা, লঞ্চগুলো পরিবহন করছে ধারণক্ষমতার তিনগুণেরও বেশি যাত্রী। এছাড়া বাসে বাড়তি ভাড়ার ভোগান্তির অভিযোগ অধিকাংশেরই।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আরেফিন হক। রবিবারে অফিস খুলবে এজন্য একদিন হাতে রেখেই ঢাকায় আসার উদ্দেশে বরগুনা থেকে রওনা দেন তিনি। শুক্রবার বিকালে বরগুনা থেকে লঞ্চে উঠতে না পেরে বাসে বরিশাল এসেও বরিশালের লঞ্চে উঠতে না পেরে একটি মাইক্রোতে রওনা দেন ঢাকার উদ্দেশে। রাত ৩টার দিকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে পৌঁছালেও ভোর ৯টা পর্যন্ত কোনো ফেরিতে উঠতে পারেনি আরেফিনদের মাইক্রোটি। ফলে তিনি গাড়ি থেকে নেমে লঞ্চযোগে শিমুলিয়া পৌঁছান।
আরেফিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভেবেছিলাম লঞ্চে স্বাচ্ছন্দে ঢাকায় পৌঁছাবো কিন্তু ভেঙ্গে ভেঙ্গে এসেও দুপুরের পরে ঢাকায় পৌঁছাতে পেরেছি। প্রায় ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে বাড়ি থেকে ঢাকায় আসতে, সাথে ভোগান্তি আর অতিরিক্ত ভাড়া তো আছেই।'
মুলাদি থেকে লঞ্চে ঢাকায় আসা একটি হোটেলের কর্মচারী সুজন হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, 'পুরো লঞ্চে পা ফেলার মতো জায়গা ছিল না। অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে বরিশাল থেকে পারাবাত-৯ লঞ্চে উঠে কেবিনের মাঝে ফাঁকা স্থানে কোনোভাবে বসে এসেছি। ভোরে এসে সদরঘাটে নামিয়ে দিলেও সেখান থেকে বাসগুলো ২৫ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা রেখেছে।'
বরিশাল নৌবন্দরের দেওয়া তথ্যমতে, শুক্রবার সন্ধ্যায় বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে ১৩টি লঞ্চ যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসে।
সন্ধ্যার মধ্যেই ১৩টি লঞ্চের প্রায় প্রতিটিই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এসব লঞ্চের ডেক ছিল যাত্রীতে ঠাসা। যারা ডেকে স্থান পাননি, তাঁরা দুইতলা ও তিনতলার কেবিনের সামনে ফাঁকা জায়গায় চাদর বিছিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। এমনকি লঞ্চগুলোর ভিআইপি কেবিনের করিডরেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
শনিবার সকাল থেকে বাংলাবাজার ও দৌলতদিয়া ঘাটে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে চাহিদা অনুযায়ী কম ফেরি চলায় পদ্মা পারাপারে যাত্রী ও যানবাহনগুলোকে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ কারণে চরম দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন কর্মস্থলমুখী যাত্রী ও পরিবহনের শ্রমিকেরা।
এছাড়া রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় প্রায় ১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত যানবাহনের সারি তৈরি হওয়ায় শুক্রবার রাতে আসা গাড়িগুলো ১২ ঘণ্টার আগে ফেরির দেখা পায়নি। দীর্ঘ যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। অনেক যাত্রী ফেরিতে উঠে পড়ায় যানবাহন ওঠার সুযোগ পায় কম।
মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় শুক্রবার রাত থেকে জড়ো হতে থাকে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল ও যাত্রীরা। বাংলাবাজার লঞ্চে করে আসা যাত্রীদের গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় বেশ অনেকটা সময় আর বাসে করে ঢাকায় পাড়ি দিতে গুনতে হয় অতিরিক্ত ভাড়া।
ভোর থেকে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকায় বাংলাবাজার ঘাটের টার্মিনাল ও সংযোগ সড়কে অন্তত চার শতাধিক যানবাহন আটকা পড়ে ছিল। এর সিংহভাগই ব্যক্তিগত গাড়ি।
লঞ্চঘাটেও ঢাকামুখী যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে।
শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি নৌরুটে ১০টি ফেরি দিয়ে ২৪ ঘণ্টা যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহমদ নিশ্চিত করেন। এছাড়া ১৫৫টি স্পিডবোট ও ৮৫টি লঞ্চ দিয়ে যাত্রী পারাপার করা হয় বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ শিমুলিয়া ঘাটের বন্দর কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন।
এদিকে ঢাকাগামী যাত্রী আশিক চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'গ্রেট বিক্রমপুর পরিবহনে করে ঢাকা যাব। আমার কলেজ খুলবে বলে আগেভাগে ঢাকা যাচ্ছি। ৮০ টাকার ভাড়া ১৫০ করে নিচ্ছে।'
ইলিশ পরিবহনের বাস চালক জয়নাল মিয়া জানান, '৮৫ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা রাখতেছি। এর বেশি দেয় না। ঢাকা থেকে খালি গাড়ি আসতে হইতাছে তেলের খরচ লাগে না? যদি খালি গাড়ি না আহি, ঢাকায় পইড়া থাকি তাহলে এখানে যাত্রীর ভিড় লাগবো।'
বিআইডব্লিউটিএ শিমুলিয়া বন্দর কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, লঞ্চঘাট এলাকায় যাত্রীদের বাড়তি চাপ রয়েছে। বাংলাবাজার থেকে যেসব লঞ্চ আসছে প্রতিটি লঞ্চে যাত্রীতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। শুক্রবার ২৯২টি লঞ্চ ট্রিপে ৮০০০০ এর উপরে যাত্রী পারাপার করেছে।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াসিনা ফেরদৌস রিথি জানান, 'আমরা ইতিমধ্যে খেয়াল করেছি দু-একটা বাস অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই কঠোরভাবে বলা হয়েছে যাতে যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়া হয়।'
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় শুক্রবার রাতে আসা গাড়িগুলো ১২ ঘণ্টার আগে ফেরির দেখা পায়নি। দীর্ঘ যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। অনেক যাত্রী ফেরিতে উঠে পড়ায় যানবাহন ওঠার সুযোগ পাচ্ছে কম। এ গাড়িগুলোর অধিকাংশ যাত্রীই গাড়ি থেকে নেমে ৮-১০ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে লঞ্চ কিংবা ট্রলারে নদী পার হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন।
দৌলতদিয়ায় যেখানে উপচেপড়া ভিড় ছিল সেখানে পাটুরিয়া ঘাট ছিল অনেকটাই ফাঁকা। রাজধানী থেকে পাটুরিয়া ঘাটে আসা গাড়িগুলো নির্বিঘ্নে ফেরি পারাপার হতে পারছে।
শনিবার সকাল থেকেই দৌলতদিয়া ঘাটে মানুষের ঢল নামে। প্রতিটি ঘাটেই ছিল মানুষের ভিড়। এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা যাত্রীবাহী শত শত পরিবহন যানজটে আটকে ছিল। ফেরিঘাট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দের জমিদার ব্রিজ পর্যন্ত যানজট প্রায় ১০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে গাড়ির সারি আরও দীর্ঘ হয়।
ঝিনাইদহ থেকে শনিবার সন্ধ্যায় ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী একটি বাসের চালক আজগর আলী টিবিএসকে বলেন, 'শনিবার রাত ১০টা থেকে প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে ঘাটের জ্যামে আটকে ছিলাম। যাত্রীরা সবাই ক্লান্ত হয়ে অনেকেই নেমে হেঁটে গিয়ে লঞ্চে পারাপার হয়েছেন।'
যশোর থেকে ঢাকায় আাসা যাত্রী সাব্বির হোসেন বলেন, 'শনিবার রাত ৮টায় রওনা দিয়ে রাত ১১টার দিকে ঘাট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পেছনে আটকা পড়েছিলাম। সেখানে প্রায় ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঘাটে এসে ভোরে লঞ্চে পার হয়ে ১১টার দিকে ঢাকায় পৌঁছাই। শনিবার সকাল থেকে অফিস ছিল কিন্তু এতো ক্লান্ত ছিলাম অফিস করার সুযোগ হয়নি।'
দৌলতদিয়া ঘাট নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (ওসি) সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, ঈদ শেষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ কর্মস্থলের দিকে ছুটছেন। এ কারণে ঘাট এলাকায় এত চাপ পড়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক শাহ মো. খালিদ নেওয়াজ বলেন, ২৪ ঘণ্টায় ৯ হাজার ২৭টি যানবাহন পার হয়েছে, যা বিগত কয়েক দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে মোটরসাইকেল পার হয়েছে আড়াই হাজার এবং ছোট গাড়ি ছিল প্রায় ছয় হাজার।
এদিকে দেশের উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী মহাসড়কে যানবাহন চাপ বাড়ায় সড়কের কোথাও কোথাও ধীরগতিতে যানবাহন চললেও তেমন কোনো যানজট ছিল না রাস্তায়। অন্যান্য ঈদের তুলনায় এবারের ফিরতি যাত্রা অনেকটাই স্বস্তির বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা।
সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কের ঢাকাগামী লেনে যানবাহন বাড়তে থাকায় সড়কে ধীরগতি দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়ক থেকে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কের চান্দাইকোনা পর্যন্ত যানবাহনের চাপে ধীরগতির সৃষ্টি হলেও কোথাও কোনো ধরনের যানজট ছিল না।
বাস চালক-হেলপার ও যাত্রীদের সাখে কথা বলে জানা গেছে,পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে গত রবি, সোম ও মঙ্গলবার ঢাকা, সাভার, চন্দ্রা ও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন পোশাক কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক দুই শতাধিক দোতলা, শতাধিক একতলা বিআরটিসি বাস ও বিভিন্ন পরিবহন রিজার্ভ করে রংপুরে এসেছেন। ঈদের ছুটি শেষে শুক্রবার থেকে বাসগুলো শ্রমিকদের নিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছে।
সড়ক ও নৌপথের মতোই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনে করে ঢাকায় ফেরা মানুষের চাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। শনিবার ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগ দিতে রাজধানীতে ফিরছেন হাজারও মানুষ। প্রতিটি ট্রেনই শতভাগ যাত্রী নিয়ে কমলাপুর পৌঁছেছে। কোনো কোনো ট্রেন আসনের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনও করেছে।
শনিবার দুপুর পর্যন্ত কমলাপুর রেলস্টেশনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ১৫টি ট্রেন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছে। প্রতিটি ট্রেনেই ছিল যাত্রীদের চোখে পড়ার মতো ভিড়। অনেকেই ট্রেনে সিট না পেয়ে স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটে ঢাকায় এসেছেন।