নদীতে বিলীন ইউনিয়ন, অস্তিত্ব শুধু কাগজে-কলমে, তবু চলছে নির্বাচন
ভোলার দৌলতখান উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নে কাগজে-কলমে ভোটার থাকলেও নেই ইউনিয়নের অস্তিত্ব। তবু ইউনিয়নটিতে ইভিএম পদ্ধতিতে চলেছে ভোটগ্রহণ।
বছরখানেক আগেই নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেলেও কাগজে-কলমে চলছে ইউনিয়নের কার্যক্রম। ইউনিয়নটিতে কোনো স্থলভাগ না থাকায় আজ ১৫ জুন বুধবার পৌরসভার সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে একত্রে ৯ ওয়ার্ডের ভোট গ্রহণের কাজ চলছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে সদরজমিন উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, নদীর মাঝে জনমানবহীন ইউনিয়ন। নেই তেমন কোনো ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত বছরে মেঘনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়সহ নানা স্থাপনা।
স্থানীয়রা জানান, ভোলার দৌলতখান উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন প্রচীনতম ইউনিয়ন হাজীপুর। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে একটু একটু করে মেঘনার ভাঙনে ইউনিয়নটি বিলীন হয়ে যায়। সর্বশেষ গেল বছরের শেষের দিকে ইউনিয়নটিতে থাকা হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি মেঘনার করাল গ্রাসে ভেঙে গেছে। বর্তমানে ওই ইউনিয়নটির বিচ্ছিন্ন কয়েকটি চর রয়েছে। তা-ও জোয়ারের পানিতে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে থাকে।
৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ইউনিয়নটির মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৪০ জন। তবে ইউনিয়নটির কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও দু-তিনটি চরে রয়েছে গরু-মহিষের ঘর ও কয়েকটি মাছের আড়ত। ভাঙনে বাড়িহারা মানুষ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। ইউনিয়নের কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকলেও সেখানে বসতি নেই কারো।
তারপরও চলছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে হাজীপুর ইউনিয়নে প্রার্থীরা পোস্টার লাগাতে না পারলেও পোস্টারে ছেয়ে গেছে পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী ভবানীপুর, চর খলিফা ও সৈয়দপুর ইউনিয়নও পোস্টারে ছেয়ে গেছে।
জানা যায়, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের জন্ম এই হাজীপুর ইউনিয়নে। এই বীরশ্রেষ্ঠের জন্মভূমিটুকু রক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ইউনিয়টির বাসিন্দারা।
এই ইউনিয়নের বাসিন্দা আলম সিকদার, সফিজল ও হারুন মালসহ একাধিক ভোটার বলেন, নদীভাঙনের কারণে ইউনিয়টি বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখানকার বাসিন্দারা এখন বিভিন্ন উপজেলায় বসবাস করে অন্য ইউনিয়নের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। আর এই ইউনিয়নের সরকারি বরাদ্দ তারা কিছুই পাচ্ছে না। নির্বাচন এলে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চান প্রার্থীরা। ভোট শেষ হলে তাদের আর খোঁজখবর থাকে না। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ না থাকায় পরিষদ থেকে দাপ্তরিক কাগজপত্রের জন্য তাদের দিনের পর দিন ঘুরতে হয়।
হাজীপুর ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. হামিদুর রহমান টিপু ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবী আবদুল্লাহ কিরন পাঠওয়ারী জানান, নির্বাচন শেষে হাজীপুর ইউনিয়নে বসবাসের উপযোগী আশ্রয় প্রকল্প নির্মাণের পাশাপাশি নানা নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা।
এদিকে দৌলতখান উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. আবদুস সালাম জানান, হাজীপুর ইউনিয়নটি নদীর মাঝখানে হওয়ায় ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট নেওয়ার পরিবেশ ও পরিস্থিতি নেই। পাশাপাশি বর্ষার সময় নদী উত্তাল থাকায় দৌলতখান পৌরসভায় ভোট গ্রহণের আয়োজন করা হয়েছে। আজ চলছে ইউনিয়নটির শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহম।
ইউনিয়নটি নদীগর্ভে বিলীন, তারপরও নির্বাচন কীভাবে হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, 'ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব ঠিক করেছেন। আমাদের কাজ হলো নির্বাচন পরিচালনা করা। আমরা তা-ই করছি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা করার প্রয়োজন আমরা তাই করেছি।'
দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তারেক হাওলাদার জানান, নদীভাঙনের কারণে ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে কি না বিষয়টি দেখবে নির্বাচন কমিশন। পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য ছাড়া কোনো ইউনিয়নকে বিলুপ্ত বলা যায় না।
তিনি আরও জানান, '২০১১ সালের আদমশুমারি বিবেচনায় নিয়ে জনসংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন বিলুপ্ত বা নেই, তার কোনো অফিসিয়াল অর্ডার নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা। তারা ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা বিলুপ্ত বলতে পারি না। বিলুপ্ত হয়েছে এমন কোনো পত্র নেই। ভোটের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জেলা, সদর ও দৌলতখান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা সরেজমিন দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা পুরোপুরি তাদের বিষয়। আমরা প্রশাসন নিরাপত্তার বিষয়টি দেখব, অন্য কিছু নয়।'
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সৈয়দ শফিকুল হক জানান, 'চরাঞ্চলে যেহেতু বর্ষার সময় কোনো মানুষ থাকে না, সবাই উপজেলার উপস্থলে বিভন্ন এলাকায় থাকে। এছাড়া চরে ২-১টি মহিষের টিলা, মাছের আড়ত আছে, তাই সেখানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কিংবা নির্বাচনের সঙ্গে দ্বায়িত্বপ্রাপ্তরা স্পটে গিয়ে থাকতে পারবে না। তাই আমরা এসব দেখে কমিশনের কাছে মেইনল্যান্ডে নির্বাচন করার অনুমতি চেয়েছি এবং কমিশন অনুমতি দিয়েছে।'
দুটি মহিষের ঘর আর মাছের আড়ত নিয়ে একটি ইউনিয়ন কীভাবে হয়—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে, তার প্রতিনিধি হিসেবে আমরা নির্বাচন পরিচালনা করছি।'
উল্লেখ্য, অষ্টম ধাপে হাজীপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ২ জন, মেম্বার পদে ২৩ জন এবং সংরক্ষিত আসনে ১৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।