কিশোরগঞ্জের অল-ওয়েদার সড়ক সমাধানের বদলে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে
কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের তিনটি উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে নির্মিত হয়েছিল ২৯.৭৩ কিলোমিটারের দীর্ঘ একটি সড়ক, কিন্তু ওই অঞ্চলে সুবিধা দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তাটি। অকাল বন্যা দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাচ্ছে।
কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার বাসিন্দারা বলছেন, ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬-২০২০ সালের মধ্যে নির্মিত এই সড়কের কারণে ঢলের পানি হাওর থেকে দ্রুত নদীতে নামতে পারছে না। সড়কের দু'পাশে সবুজ ধানক্ষেত বর্ষায় পানিতে থৈ থৈ করে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে সুলতানপুর গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক বছরই মার্চ এপ্রিলে ঢল নামে। আগে ঢল এলেও পানি দ্রুত নেমে যেতো। "এখন পানি আটকে থাকে কয়েকদিন। এতে পানিতে ধান পচে যায়।"
এ বছরও এপ্রিলে অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান। এতে ক্ষতির পরিমান হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এবারের অকাল বন্যার পর থেকেই আলোচনায় আসে এই সড়ক। স্থানীয় মানুষ, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে মন্ত্রীসভায় আলোচনা হয়েছে হাওরের জন্যে ভয়ের কারণ হয়ে ওঠা কিশোরগঞ্জের এই সড়ক নিয়ে। হাওরের বন্যায় এই সড়কের কোন প্রভাব রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বলেছে মন্ত্রীসভা। একইসঙ্গে হাওর এলাকায় আর কোন সড়ক নির্মাণ না করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওার আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা না চালানো এর অন্যতম কারণ।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান এই সড়ক নিয়ে সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো হয়নি।
তিনি বলেন, "হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয় তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটার এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানি প্রবাহের সুযোগ রাখা হয়। এ বিষয়ে তখন একটি লিখিত প্রস্তাাবও আমি দিয়েছিলাম। এছাড়া এই সড়কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো হলো, এটি একা দাঁড়িয়ে থাকা এক সড়ক, এই সড়ক ব্যাপক অর্থে কোনো সংযোগ তৈরি করছে না।"
সাক্ষাতকারে খালেকুজ্জামান বলেন, "সড়কটি নির্মাণের মাত্র দুই বছর হয়েছে। আরও সময় গেলে, বড় বড় বন্যার তোড় দেখা দিলে এই সড়কের পরিবেশগত প্রভাব আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।"
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী নিতেশ বড়ুয়া বলেন, "বিষয়টি যেহেতু উচ্চ পর্যায়ের বিবেচনাধীন আছে, তাই এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করবো না। তবে এটুকু বলতি পারি, এখন হাওরের দুপাশে কোন পানি নেই। এবং সড়কে পানি যাওয়ার জন্য অনেক সেতু আছে।"
যদিও হাওরে এবার অকাল বন্যায় ফসলহানির পর গত ১৮ এপ্রিল মন্ত্রীসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, হাওরে আর সড়ক নির্মাণ করা হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, হাওরের মাঝখানে এভাবে সড়ক নির্মাণই হাওরের প্রকৃতিবিরুদ্ধ। এতে পানির গতিধারা ব্যহত হবেই।
কাসমির বলেন, "ওই সড়কে পানি চলাচলের জন্য যথেষ্ট পরিমান সেতু নেই। ৩০ কিলোমিটার সড়কে পানি নামার রাস্তা আছে ৯০০ মিটারের মতো। এটা খুবই অপর্যাপ্ত। আর হাওরের পানির চরিত্র হচ্ছে বিস্তৃর্ণ এলাকা নিয়ে চলে। সরু সেতু দিয়ে এই পানি নামতে সময় বেশি লাগবেই। ফলে সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জ হয়ে কিশোরগঞ্জে গিয়ে হাওরের পানি আটকে থাকে।"
"হাওরে পানি নামতে যদি দুইদিনও দেরি হয়, তাহলেও কিন্তু ফসলের বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক ধান পচে যায়", যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, "হাওরে সড়ক হলে তো সেখানকার পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবেই। শুধু কিশোরগঞ্জের সড়কই না হাওর এলাকায় যত্রতত্রভাবে সড়ক নির্মাণের ফলে এখন ঘনঘন বন্যা দেখা দিচ্ছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।"
"হাওরে সড়ক হবে কেন? সড়ক পথের চেয়ে ওই এলাকায় নৌ চলাচলকে আধুনিক ও উন্নত করা প্রয়োজন।"
ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নামা ঢলের পানি সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওর হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে গিয়ে মেশে। এই অ-ওয়েদার সড়কের কারণে হাওরের পানি নদীতে নামতে পারছে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য মতে, ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অল-ওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসিগার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ রয়েছে।
গত এপ্রিলে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছিলেন, এখন ওই সড়কে সেতুর সংখ্যা বাড়িয়ে পানি প্রবাহ বাড়ানো যায় কিনা, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে এ বিষয়ে সমীক্ষা চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রতি আধা কিলোমিটার পরপর দেড়শ থেকে দুইশ মিটার ব্রিজ করে দেওয়া যায় কিনা তা যাচাই করতে জরিপ করতে বলা হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, উঁচু সড়ক হাওর এলাকায় পানি চলাচলে বাধা দেয়। এখন থেকে হাওরে আর কোনও উঁচু সড়ক নির্মাণ করা হবে না, শুধু উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে।
সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৭টি জেলার ৫০টি উপজেলার ১৪ হাজার ৫৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাওর অঞ্চল বিস্তৃত। এখানে ৪১৪ টি হাওর আছে।
বছরের বেশিরভাগ সময়ই যেহেতু হাওর এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে তাই ওই এলাকায় তেমন কোন ফসল হয় না। শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে হাওরের অধিকাংশ স্থানে বোরো ফসল ফলানো হয়। এই ধানই হাওর এলাকার মানুষের একমাত্র ফসল। বাংলাদেশের মোট ধান উৎপাদনের ১৬ শতাংশই আসে হাওর অঞ্চল থেকে। হাওর এলাকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষি আর মৎস্যজীবী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হাওরের ৭টি জেলায় এবার ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে।