রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেতেও ঘুষ দিতে হয় বীরাঙ্গনাদের: টিআইবি
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে সকল নারী (বীরাঙ্গনা) পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের দ্বারা নির্যাতনে শিকার হয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি তালিকা প্রনয়নে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে বলে উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায়।
একইসাথে চিহ্নিত হওয়ার পর বীরাঙ্গনার তালিকা গেজেটে নাম যুক্ত করতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। সরকার যেসকল সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করেছে বীরঙ্গনাদের জন্য, সেগুলো পেতেও সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করা এবং ঘুষও দিতে হয় বলে গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, "মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পরে হলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান সরকারের একটি অনন্য পদক্ষেপ। তবে বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় নানা ঘাটতি বিদ্যমান। বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক সেখানে পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, কাঠামোগত জটিলতা, অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ, জবাবদিহি ব্যবস্থা ও সংবেদনশীলতায় ঘাটতি প্রক্রিয়াটিকে করে তুলেছে জটিল।"
"তার সাথে সামাজিক সচেতনতা ও সংবেদনশীলতার ঘাটতিও লক্ষণীয়। স্বাধীনতার এতো বছর পরও সামাজিক মূল্যবোধে অনেকাংশেই স্থবিরতা রয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বীরাঙ্গনারা এখনো প্রান্তিকীকরণের শিকার। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ও নারী বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়ার নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক কাজ থাকলেও তা নারী বিষয়ক অন্য যেকোন কাজের তুলনায় বেশ অপ্রতুল।"
"বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রদানের এই প্রক্রিয়াটি গতানুগতিক অন্যান্য প্রক্রিয়া হতে ভিন্ন। কিন্তু বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়াটি গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিনির্ভর। সংবেদনশীল এই বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় না রাখার কারণে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বীরাঙ্গনাদের জন্য অনেকক্ষেত্রেই জটিলতার সৃষ্টি করছে," বলেন তিনি।
'বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করে টিআইবি। এ উপলক্ষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গবেষণাটি উপস্থাপন করেন সংস্থাটির রিসার্চ এসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে গেজেটভুক্ত মোট বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪৮ জন (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী) হলেও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এমআইএস-এ এন্ট্রি রয়েছে ৪০৩ জনের তালিকা।
দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেজেটভুক্ত হয়েছে রাজশাহী বিভাগে (১০৭ জন)। এরপরে রয়েছে রংপুর বিভাগ, এ বিভাগে গেজেটভুক্ত হয়েছে ৬১ জন। সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগে গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি, ৫২, ৫১ এবং ৫০ জন। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের যথাক্রমে গেজেটভুক্ত হয়েছে ৪৫ ও ৪০ জন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম গেজেটভুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে, ২৮ জন। এখন পর্যন্ত একজন করে গেজেটভুক্ত হয়েছে এমন জেলার সংখ্যা ৯টি। এখন পর্যন্ত একজন বীরাঙ্গনাও গেজেটভুক্ত হয়নি এমন জেলার সংখ্যা ৮টি। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হতে গেজেটভুক্ত হয়েছেন তিনজন।
একজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, "হেরা তো কয় ঘর পাইতে হইলে তো টাকা পয়সা কিছু খরচ করতে হইবো। সরকার তোমারে এতো লাখ ট্যাকার ঘর দিবো, তোমারেও তো কিছু দিতে হইবো...লাখ খানেক টাকা চায়...তা না হইলে ঘরের নাকি ব্যবস্থা হইবো না।"
গবেষণায় উঠে আসে, ২০১৫ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রদানের সরকারি কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির এই প্রক্রিয়ায় বীরাঙ্গনাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
গেজেটভুক্তির আবেদন হতে শুরু করে গেজেটভুক্তি জন্য সর্বোচ্চ কতদিনে মধ্যে কার্যক্রম নিষ্পত্তি করতে হবে তার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা আইনে বা বিধিতে উল্লেখ নেই। ফলে গেজেটভুক্তির এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অনেকক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময়- কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়।
গেজেটভুক্তির পর ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ। গেজেটভুক্তির পর ভাতা পেতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩-৬ মাস পর্যন্ত বা এরও বেশি সময় লেগে যায়। সম্মানি ভাতার আবেদন করা আবেদন প্রাপ্তির তারিখ হতে পরবর্তী ৬০ (ষাট) কার্যদিবসের মধ্যে আবেদনটি নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা থাকলেও অনেকক্ষেত্রেই তা যথাযথভাবে পালিত না হওয়ায় ভাতা প্রাপ্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়ে পড়ে।
এছাড়া বীর নিবাসের ঘরের জন্য আবেদন করলে তা পেতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এক্ষেত্রেও সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে আবেদন করার ৬ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও কেউ কেউ এখনো ঘর পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবেদন যাচাই বাছাই এর জন্য কিছু কিছু সনদ প্রদর্শন করতে হয়। এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে।
বীরাঙ্গনা নিয়ে কাজ করে এমন একজন স্বেচ্ছসেবির সাক্ষাতকার গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। তিনি বলেন, "বীরাঙ্গনাদের তালিকাভুক্তির এই পুরো প্রক্রিয়াটাই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। অনেককেই কোনো না কোনোভাবে টাকা পয়সা দিতে হয়। তারা দেয়। কিন্তু এটা নিয়ে তারা কথা বলে না। এমনেই নানান জটিলতা আছে। এরপর এটা নিয়ে নতুন করে আর কোনো ঝামেলা হোক সেটা চায় না। অনেকে ভয় পায়, এতে না আবার শেষে বাতিল হয়ে যায়। যে যতটা পারে দেয়।"
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া একটি অনন্য উদ্যোগ। তবে তাদেরকে গেজেটভুক্ত করতে নানা ধরনের জটিলতা এবং সুযোগ সুবিধা পেতে ঘূষ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বীরঙ্গনাদের স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সেটির ঘাটতি রয়েছে।