গরুর ঘাস কাটতে গিয়ে কৃষকের মৃত্যু, নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের সমাজ সহিলদেও ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম মুন্সি রোববার সকালে স্থানীয় হাওড়ে তার গরুর জন্য ঘাস কাটতে যান। ত্রাণের খাবার শুকনো খাবার থাকলেও গরু তো না খেয়ে থাকবে। তাই চারদিকে অথৈ পানির মধ্যেই ঘাস কাটতে যান তিনি।
ঘাস কাটতে যাওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি।
পরে তার লাশ ভেসে ওঠে পানিতে, স্বজনরা লাশ উদ্ধার করে দাফন করেন। মোহনগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছাব্বির আহমেদ আকুঞ্জিও তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এএইচএম আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ওই উপজেলার ৬ ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামের সব ক'টি গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের বেশিরভাগ লোকের ঘরে বন্যার পানি ঢোকায় সেখানে বসবাস অনিরাপদ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক পরিবারের রান্নাবান্না।
দুর্গত পরিবারগুলো সহায়-সম্পদ ও গবাদিপশু নিয়ে ৫২টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও আশ্রয়কেন্দ্র খুলতে হয়েছে।
সরেজমিনে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, মানুষ গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি নিয়ে অত্যন্ত গাদাগাদি করে দুর্বিষহভাবে বসবাস করছেন।
নেত্রকোনার হাওড়দ্বীপ খালিয়াজুরী, কলমাকান্দা, মোহনগঞ্জ ও মদনসহ ৯ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। শুধু দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানি কমছে।
নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দাসহ ৯ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানি কমছে।
জেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্যানুযায়ী ১০ উপজেলার ৮৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬২টি ইউনিয়নই ভয়াবহভাবে বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যার পানিতে পানিবন্দি হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ১ হাজার ৯শ ২৮টি পরিবার। বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭০ জন মানুষ। ৩২৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৬৯৮ জন মানুষ। এরমধ্যে ১৬ হাজার ৮৮ জন শিশু এবং ৭৬৩ জন প্রতিবন্ধী রয়েছেন।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সংগ্রহ করা তথ্যের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নেত্রকোনার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত সোমবারের সর্বশেষ পরিসংখ্যানের বরাতে জানিয়েছেন, সোমেশ্বরী, কংস ও ধনু নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। কলমাকান্দা পয়েন্টে সোমেশ্বরীর পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার, জারিয়া পয়েন্টে কংসের পানি বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার এবং খালিয়াজুরী পয়েন্টে ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে সোমবার রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় আবারও পানি বাড়ার আশঙ্কা করছেন বানভাসীরা।
এদিকে বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো বাতাসে খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ ও মদনের হাওর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
খালিয়াজুরীর পুরানহাটি গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, 'একটু বাতাস হলেই হাওরে ঢেউ উঠছে এবং তা বাড়িঘরে এসে আঘাত হানছে। এজন্যে অনেকের বাড়িঘর ভাঙছে। কারও কারও ঘরের মেঝের মাটি সরে যাচ্ছে।'
'বর্ষাকালে হাওরের লোকজন ভাঙন ঠেকানোর জন্য বাড়িঘরের চারপাশে বাঁশ, কাঠ, খড় প্রভৃতি দিয়ে একধরনের অস্থায়ী প্রাচীর তৈরি করেন। কিন্তু এবার বর্ষার শুরুতেই বন্যা দেখা দেয়ায় কেউই সে প্রস্তুতি নিতে পারেনি।'
এদিকে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও চলছে নানা সঙ্কট। বেশিরভাগ আশ্রয়কেন্দ্রই পানিবন্দি।
অনেকগুলোর নিচতলা এবং টয়লেট ও নলকূপ ডুবে গেছে। এ কারণে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পয়ঃনিষ্কাশন ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট চলছে।
খালিয়াজুরীর সিদ্দিকুর রহমান বালিকা বিদ্যানিকেতনে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রটিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ১৭টি দুর্গত পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির নিচতলায় থাকা সবগুলো টয়লেট পানিতে ডুবে যাওয়ায় আশ্রিতরা বাঁশ দিয়ে একটি বিকল্প টয়লেট বানিয়ে ব্যবহার করছেন। কিন্তু নারী ও শিশুরা সেখানে যেতে পারছে না।
একইভাবে খাবার পানিও সংগ্রহ করছেন উপজেলা সদর থেকে। তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবারের কোনো সঙ্কট নেই বলে জানিয়েছেন আশ্রিতরা।
এদিকে হাওরাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িঘরে পানি ঢুকলেও কিছুদিন আগে তোলা বোরো ধানের গোলাসহ অন্যান্য সহায়-সম্পদে রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছেন না অনেক পরিবার। এ পরিবারগুলো আরও বেশি দুর্ভোগে রয়েছে। কারও কারও ধানের মাচা পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। চুলা ডুবে যাওয়ায় অনেক পরিবারের রান্না হচ্ছে চৌকি বা খাটের ওপর।
আবার কেউ কেউ আত্ময়ি-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদের উঁচু বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছেন। খালিয়াজুরীর নূরপুর বোয়ালী গ্রামের আব্দুল আজিজ বলেন, 'ঘরে অন্তত ১০০ মন ধান এবং চারটা গরু আছে। এগুলো রেখে কীভাবে যাব?'
মোহনগঞ্জের মল্লিকপুর গ্রামের জীবন সরকার বলেন, 'আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও তো স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। তাছাড়া সেখানে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির নিয়ে গাদাগাদি করে থাকা খুবই কষ্টকর। তাই বাড়িইে থাকছি।'
সিভিল সার্জন ডা. সেলিম মিয়া জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ১০ উপজেলার জন্য ৮৯টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত মাঠে কাজ শুরু করেছে ৮২টি টিম। এসব টিমের সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছে।
ওদিকে পর্যাপ্ত নৌকার অভাবে হাওরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে যাতায়াতেরও সঙ্কট চলছে। প্রয়োজনীয় যাতায়াতের জন্য নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। নৌকার অভাবে দুর্গত লোকজন হাটবাজারে পর্যন্ত যেতে পারছেন না। আবার নৌকা পেলেও ভাড়া গুনতে হচ্ছে খুব বেশি।
সমুদ্রসমেত হাওরে ছোট নৌকা চালাতেও ভয় পাচ্ছেন অনেকে। খালিয়াজুরীর বল্লভপুর গ্রামের আকাশ সরকার বলেন, গত কয়েক বছর এমন বর্ষা হয়নি। এ কারণে অনেকের বাড়িতেই নৌকা নেই। কিন্তু এবার হঠাৎ করে বন্যা হওয়ায় পর্যাপ্ত নৌকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
আবার হাওরের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎ লাইনগুলো পানির উচ্চতার কাছাকাছি চলে আসায় সেদিক দিয়ে বড় নৌকাও চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে উপজেলা প্রশাসন এবং পল্লীবিদ্যুত সমিতি থেকে সতর্ককতামূলক মাইকিং করা হয়েছে।