‘কেউ পাঁচবার ত্রাণ পাচ্ছে, কেউ একবারও পাচ্ছে না’
১৫ জুন থেকে বন্যা শুরু হয় সিলেটে। প্রথমদিনে তলিয়ে যায় ভারতের মেঘালয়ের লাগোয়া সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। ওনদিন থেকেই পানিবন্দি হয়ে আছেন গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুরের রাহেলা খাতুন। এই দশদিনের মধ্যে একদিন কিছু শুকনো খাবার ও দুদিন রান্না করা খাবার পেয়েছিলেন তিনি।
রাহেলা বলেন, '১০ দিন ধরে ঘরে আটকে আছি। চারদিকে পানি, কোথাও যেতে পারছি না। মাত্র তিন দিনের সাহায্যে তো আর চলছে না। ঘরে বাচ্চা ও শাশুড়িকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি।'
এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি সহায়তা পাননি বলে জানান জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুলের দিনমজুর আফরোজ আহমদ। তিনি বলেন, 'এলাকার ছেলেরা মিলে কিছু সাহায্য করছে। সরকারের কেউ বা কোনো জনপ্রতিনিধি এখন পর্যন্ত আমাদের খোঁজও নেয়নি।'
বৃহস্পতিবার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরেছেন জানিয়ে আফরোজ বলেন, 'ঘর তো তছনছ করে দিয়েছে পানি। ঘরে খাবারও নেই। এখন পরিবার নিয়ে কী খাব?'
বন্যায় পানিবন্দি থাকা ১০ দিনে মাত্র চারদিন ভাত খেয়েছেন জানিয়ে গোয়াইনঘাটের তোয়াকুল এলাকার ভ্যানচালক আব্দুল করিম বলেন, 'শুকনো খাবার অনেক পেয়েছি। কিন্তু চাল-ডাল পাচ্ছি না। ভাত না খেয়ে কতদিন থাকা যায়? ঘরের বাচ্চারা তো ভাত ছাড়া বুঝতেই চায় না।'
এমন হাহাকারের কথা জানিয়েছেন বন্যাকবলিত আরও অনেকেই। পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ তাদের।
অথচ শুক্রবার ত্রাণবাহী ট্রাকের কারণে সিলেট ঢাকা-মহাসড়কে রীতিমত জট লেগে গিয়েছিল। একইদিনে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জগামী সড়কে প্রতি মিনিটে প্রবেশ করেছে ত্রাণ বহনকারী একাধিক ট্রাক। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ত্রাণ নিয়ে আসে এসব ট্রাক।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সারা দেশের মানুষ। মানুষের অভূতপূর্ব সহায়তায় বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চলছে এই দুই জেলায়। সরকারের পক্ষ থেকেও ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এই কাজে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনীও।
এত বিপুল ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও মানুষের হাহাকার কমছে না। অনেকের হাতেই পৌঁছছে না ত্রাণ। ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও বানভাসী মানুষের এত হাহাকার আর অভিযোগ কেন?
বন্যার শুরু থেকেই 'কলের গাড়ি' নাম দিয়ে সিলেটে ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা। কলের গাড়ির অন্যতম সমন্বয়ক, সিলেট সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তিু গুপ্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয় না হওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে।
রজত বলেন, 'সরকারের চাইতে বেসরকারি পর্যায়ে বহুগুণ বেশি ত্রাণ আসছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে যেভাবে পারে, বন্যার্তদের সহায়তা করছে। তাদের সবার উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। কারণ ব্যক্তি উদ্যোগে যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তারা কোন এলাকা বেশি দুর্গত, কারা সহায়তা পায়নি, তা জানেন না। হয়তো ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে বা পরিচিতজনদের তথ্যে তারা ত্রাণ বিতরণের এলাকা বাছাই করছেন।'
রজতের মতে, এই সমস্যা কাটাতে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে ত্রাণ কার্যবক্রম তদারকি করা প্রয়োজন। তারা বেসরকারিভাবে বিতরণ করা ত্রাণ তদারকি করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।
ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতার উদাহরণ তুলে ধরে জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান করিম বলেন, 'আমার ইউনিয়নের ৪টি গ্রামে পানি ওঠেনি। এই গ্রামগুলোর পুরোটাই আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। আশপাশের গ্রাম ও ইউনিয়ন থেকে বন্যার্তরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগই একেবারে গরিব। কিন্তু এখানে যেহেতু পানি নেই এবং সরকার ঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তাই এই এলাকায় কেউ ত্রাণ নিয়ে আসতে চায় না।'
তিনি বলেন, 'ত্রাণ নিয়ে যারা আসে তারা কেবল পানিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চায়। শুকনোয় থাকা মানুষও যে সঙ্কটে আছে তারা তা বুঝতে চায় না।'
সমন্বয়হীনতার আরেকটি উদাহরণ দিলেন গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ। তিনি বলেন, 'এখন সবচেয়ে বিপদে আছে মধ্যবিত্তরা। তারা ত্রাণ পাচ্ছে না। আবার ঘরেও খাবার নেই। সবাই শুধু দরিদ্রদের সাহায্য করছে। আমাদেরও বলে দেয়া হয়েছে, সরকারি ত্রাণ গরিব মানুষদের দিতে। কিন্তু অবস্থাসম্পন্নরাও যে এখন সঙ্কটে তা কেউ বুঝতেছে না।'
লোকমান বলেন, 'আমার ইউনিয়নে এখন সব মানুষ বিপদগ্রস্ত। আমার ঘরেই বুকসমান পানি ছিল। ঘরের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। গত বন্যায় বোরো ধানের বেশিরভাগই তলিয়ে যায়। যেটুকু ঘরে তোলা গিয়েছিল, তা এই বন্যা নিয়ে গেছে। ফলে এখন আর কেউ ভালো নেই।'
বিতরণে সমন্বয়হীনতার কারণে কেউ ৫ বার ত্রাণ পাচ্ছে, আবার কেউ একবারও পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন লোকমান আহমদ।
ব্যক্তি পর্যায়ে ও বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে আসা সবাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে বলে মনে করেন গোয়াইনঘাট উউপজেলার ৩ নং পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান লেবু।
তিনি বলেন, 'কারা ত্রাণ পায়নি, কারা বেশি দুর্গত, এসব তথ্য আমাদের কাছে আছে। তাই যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে আসলে আমরা তাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারব।'
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই চেয়ারম্যানও।
তবে এতে একটা বিপত্তি রয়েছে বলেও জানান ত্রাণ কার্যক্রম চালানো স্বেচ্ছাসেবী বিনয় ভদ্র। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, 'জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করলে অনেক সময় তারা কেবল নিজের ঘনিষ্ঠজন ও ভোটারদের সহায়তা প্রদান করেন। এতেও অনেকক্ষেত্রে প্রকৃত ভুক্তভোগীরা বঞ্চিত হয়।'
বনাকবলিত বিভিন্ন দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ আসছে কম। সবাই কেবল সড়কের কাছাকাছি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা যেখানে ভালো সেসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছেন।
তবে ভিন্ন তথ্য জানিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিক কবির আহমদ। তিনি বলেন, সবাই কেবল ত্রাণ নিয়ে দূর-দূরান্তে যেতে চায়। ফলে সড়কের কাছাকাছি এলাকার দুর্গত মানুষরা বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, কেবল শুক্রবারই কোম্পানীগঞ্জে বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে অন্তত ৫০টি ট্রাক এসেছে। পরিকল্পিতভাবে বণ্টন হলে এই ত্রাণেই দুর্গতদের এক সপ্তাহ চলার কথা।
সিলেটে চাহিদামাফিক ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, শুক্রবার পর্যন্ত সিলেট জেলায় ১,৩৯৭ মেট্রিক টন চাল, ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
এখনো কেউ না খেয়ে নেই বলে মন্তব্য করেন জেলা প্রশাসক।
সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ বিতরণের সমন্বয়হীতার কথা স্বীকার করে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবোজিৎ সিংহ জানান, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্যে প্রত্যেক উপজেলায় আলাদা আলাদা সমন্বয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শুক্রবার এই সিদ্ধান্ত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে শনিবারের মধ্যে এই গঠন কমিটি করার জন্য সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে। জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন এসব কমিটির কাজ তদারকি করবে।
দেবোজিৎ বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে আসা ত্রাণ যাতে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন হয়, প্রকৃত দুর্গতরা পায়, সে লক্ষ্যে এসব কমিটি করা হচ্ছে। সমন্বয় কমিটি বেসরকারি পর্যায়ে আসা ত্রাণ সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে সহায়তা করবে।
সমন্বয় কমিটি কীভাবে কাজ করবে, এমন প্রশ্নে দেবোজিৎ সিংহ বলেন, প্রতিটি উপজেলার প্রবেশ মুখে একটি করে কন্ট্রোল রুম চালু করবে এই সমন্বয় কমিটি। তারা উপজেলায় প্রবেশ করা সবকটি ত্রাণবাহী গাড়ি আটকে বিতরণের জন্য উপযুক্ত জায়গা নির্ধারণ করে দেবে। প্রয়োজনে জলযান ও স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে ত্রাণ বিতরণকারীদের সহায়তা করবে সমন্বয় কমিটি।