সিলেটের বন্যায় বই হারিয়ে বিপাকে শিক্ষার্থীরা, ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধির আশঙ্কা
সিলেট সদর উপজেলার রায়েরগাও এলাকার বাসিন্দা শিহাব আহমদ রাজারগাও উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। গত ১৭ জুন পানি ঢুকে পরে শিহাবদের ঘরে। বন্যার পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে তার সব বইখাতা।
শিহাব বলে, 'হঠাৎ করে পানি ঢুকে পরায় বইখাতা সরাতে পারিনি। আমরা একটা আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। শুক্রবার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এসে দেখি সব বইখাতা ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। বেশিরভাগ পাতা ছিড়ে ভেসে গেছে পানিতে'।
শিহাবের বাবা আব্দুল করিম বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ। বন্যায় সব নিয়ে গেছে। এখন থাকা-খাওয়া নিয়েই চিন্তায় আছি। বাচ্চার বইখাতা কিনবো কী করে? তাছাড়া সরকার থেকে দেয়া বিনামূল্যের বইগুলো তো বাজারে কিনতেও পাওয়া যাবে না'।
সালুটিকর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে তোফাজ্জল হোসেন। তার বইও ভেসে গেছে বানের জলে।
সোমবার তোফাজ্জল বলে, 'বন্যার কারণে কয়েকদিন ধরেই পড়ালেখা করতে পারছি না। পরিবারের সবার সাথে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। এখন বাড়িতে এসে দেখি ঘরে বই, খাতা, জ্যামিতিবক্স কিছুই নেই। সব পানিতে ভেসে গেছে'।
তোফাজ্জল আক্ষেপ করে আরও বলে, 'যেকোনো দিন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হবে। এখন আমি বইখাতা কোথায় পাব?'
সিলেটে গত ১৫ জুন থেকে বন্যা শুরু হয়। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় প্লাবিত হয় জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা। ২১ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। আর ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রায় ২৯ হাজার ঘরবাড়ি। পানি কমতে শুরু করলেও এখনও প্লাবিত রয়েছে জেলার বেশিরভাগ এলাকা।
বন্যায় শিহাব, তোফাজ্জলের মতো অনেক শিক্ষার্থীই হারিয়ে ফেলেছে বইখাতাসহ শিক্ষা সরঞ্জাম। এতে শিক্ষাজীবন নিয়ে চিন্তায় পড়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষত দরিদ্র পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে। আর সরকার থেকে দেওয়া পাঠ্যবই বাজারে কিনতে পাওয়া না যাওয়ায়- এগুলো হারিয়ে সঙ্কটে পড়েছে সব শিক্ষার্থীই। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বইসহ শিক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া না হলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে বন্যায় কী পরিমাণ শিক্ষার্থী বইখাতা হারিয়েছে এখন পর্যন্ত তার কোনো তথ্য নেই শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ, সিলেট বিভাগীয় পরিচালক অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান খান এ প্রসঙ্গে বলেন, 'ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করার জন্য আমরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়া যেসব এলাকায় অতিরিক্ত বই রয়েছে- তা সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে বলেছি।'
তিনি বলেন, এবার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। সুনামগঞ্জ তো পুরাটাই ক্ষতিগ্রস্থ। সিলেটেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একারণে শুধু অতিরিক্ত বইয়ে হবে না। আবার নতুন করে এখন বই ছাপানোও কঠিন। 'তাই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের আমরা অনুরোধ করবো সম্ভব হলে তারা যেন সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ম্যানেজ করে নেয়ার চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছি। তাদের নির্দেশনা পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
শিক্ষা অফিসের গোডাউনে থাকা বইও পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে জানিয়ে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রতুল চন্দ্র সরকার বলেন, আমাদের গোডাউনেও পানি উঠে গিয়েছিল। তাই মজুদ থাকা বইয়ের ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ক্ষতি পোষাতে ঢাকা থেকে বই পাঠাতে হবে।
তিনি বলেন, ঘরে পানির উঠার পর সবাই নিজের জীবন বাঁচাতেই মরিয়া ছিলো। বেশিরভাগই শিক্ষার্থীই বইপত্র রক্ষার সুযোগ পায়নি।
স্কুল খোলার আগে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যাবে না উল্লেখ করে এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ঈদের পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। তখন ক্ষতির পরিমাণ জেনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদা পাঠানো হবে।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জফির সেতু।
তিনি বলেন, আমি বন্যার শুরু থেকে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছি। অনেক শিক্ষার্থীই আমাকে জানিয়েছে, তাদের বই, খাতাসহ শিক্ষা-সরঞ্জাম পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। 'বই হারিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে। কারণ সামনেই তাদের পরীক্ষা।'
নিজে উদ্যোগী হয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বইখাতা কিনে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'এব্যাপারে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরই ঝরে পড়ার হার বাড়ে। এখন সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বইসহ শিক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের উদ্যোগ না নেয় তবে ঝরে পড়ার হার আরও বাড়বে। কারণ বন্যায় সব হারিয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো এমননিতেই সঙ্কটে আছে। বইখাতা কেনার মতো অর্থ তাদের কাছে নেই।'
শিক্ষার্থীদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা এখনও পাওয়া যায়নি জানিয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অভিজিৎ কুমার পাল বলেন, আমরা প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করেছি। তবে শিক্ষার্থীদের বই, খাতার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো পাইনি। স্কুল খোলার আগে এ ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে না।
একই দাবি করে জেলা প্রথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাখাওয়াত এরশেদ বলেন, আমাদের অধিদপ্তর থেকে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করতে বলা হয়েছে। আমরা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তালিকা করছি। স্কুল ভবনের কেমন ক্ষতি হয়েছে, শিক্ষার্থীদের বইখাতা কী পরিমাণ নষ্ট হয়েছে- সেগুলোর তালিকা করছি। কিন্তু অনেক জায়গা থেকে এখনো পানি নামেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষার্থীদের অধিদপ্তরে মজুদ থাকা বই বিতরণ করা হবে। আরও কোনোভাবে সহায়তা করা যায় কিনা- এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।