'আমি একজন ভণ্ড হতে যাচ্ছিলাম': লেননের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার নিলামে
চলতি মাসেই নিলামে উঠতে যাচ্ছে কিংবদন্তি শিল্পী জন লেননের একটি অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বিটলসের প্রিয় গান থেকে শুরু করে ইয়োকো অনোর সাথে প্রেম, খ্যাতি ও নিজের কপটতাসহ নানামুখী বিষয়ে কথা বলেছেন।
৯১ মিনিটের এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কানাডীয় সাংবাদিক কেন জিলিগ। বিটলস যখন ভাঙনের পথে, সেই সময়টায় ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালের মধ্যে তিন ধাপে তিনি এই সাক্ষাৎকার নেন।
আশির দশকের শেষ দিকে একটি টিভি চ্যানেল সাক্ষাতকারটির মাত্র ৫ মিনিট প্রচার করেছিল। জিলিগ মারা যান ১৯৯০ সালে, কিন্তু তার পরিবার মাত্র কিছুদিন আগেই লেননের রেকর্ডিং টেপের সন্ধান পায়। ধারণা করা হচ্ছে, নিলামে এটি ২০-৩০ হাজার পাউন্ডের মধ্যে বিক্রি হবে।
বিটলসের কোন গানটি সবচেয়ে বিখ্যাত, এই প্রশ্নের জবাবে লেনন সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমি একটু কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আমি আমার নিজের গানটাই পছন্দ করি। রেভল্যুশন #৯ আমার পছন্দ (হাসি)। 'দ্য হোয়াইট' অ্যালবামের এই গানটি ছাড়াও আরও কিছু গানের নাম জানাতে বললে, লেনন 'ওয়ালরাস, স্ট্রবেরি ফিল্ডস ফরেভার, এ ডে ইন দ্য লাইফ অ্যান্ড রেইন' গানগুলোর নাম উল্লেখ করেন।
সাক্ষাৎকারে লেনন আরও জানান, বিটলস কার্লহেইঞ্জ স্টকহাউজেন এবং জন কেজ-এর মতো সুরকারদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল, "এটা আমাদের গানকে এবং পরে অন্যান্যদের গানকেও প্রভাবিত করেছে।"
দ্য বিটলস সম্পর্কে নিজের আরও কিছু ভাবনা শেয়ার করেন লেনন, "লোকে মনে করে বিটলস একটি সম্পূর্ণ নতুন জীবন ও চিন্তাধারা প্রবর্তন করেছে। কিন্তু না, আমরা তা করিনি। আমরা বরং এর অংশ ছিলাম। সমুদ্রের একটা বড় ঢেউকে যদি আমরা 'আন্দোলন' হিসেবে ধরে নেই; তাহলে বলবো, আমরা সেই ঢেউয়ের অগ্রভাগে ছিলাম। কিন্তু আমরা নিজেরাই সেই আন্দোলন ছিলাম না।"
জিলিগ লেনন ও তার স্ত্রী ইয়োকো অনোর একসাথে সাক্ষাৎকার নেন। লেনন ১৯৬৯ সালের মার্চে অনোকে বিয়ে করেন এবং সাক্ষাৎকারেও তার প্রতি নিজের গভীর অনুরাগের কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, "অনো আসলে সেই স্বভাবজাত লেননকে ফিরিয়ে এনেছে, যে কিনা বিটলসসহ জাগতিক অন্যান্য বিষয়ে হারাতে বসেছিল। সে আমাকে 'আমি' হতে শিখিয়েছে।"
লেনন ইয়োকো অনোকে এতটাই ভালোবাসতেন যে তিনি অনোর সাথে একই মুহূর্তে মারা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, "আমি যদি তার তিন মিনিট পরেও মারা যাই, তাও আমি সহ্য করতে পারবো না। ওই তিন মিনিটও নরকসম হয়ে দাঁড়াবে আমার জন্য!"
ভালোবাসা কী, সে সম্পর্কে লেনন বলেন, "ভালোবাসাকে অনেক ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু সেসবের হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে হয়। এটা অনেকটা পোষা বিড়ালের মত...খুবই সংবেদনশীল, তাকে খুব সাবধানে রাখতে হয়।"
সাক্ষাৎকারের সময়টায় লেনন ও অনো ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন। আর্থিক সাহায্য দেওয়ার বদলে প্রতিবাদ মঞ্চায়ন করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে লেনন বলেন, "মানুষ হয়তো বলবে, আপনি খাবার দিয়ে সাহায্য করলেন না কেন? আমার উত্তর হচ্ছে, আমরা ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করতে চাইছি; ক্যান্সার হয়ে যাওয়ার পর তার প্রতিকার নয়। আমাদের কাছে যদি যথেষ্ট টাকা থাকে, আমরা দুটোই করবো। কিন্তু আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি, প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ উত্তম।"
লেনন কেন ব্রিটেনের 'এমবিই অ্যাওয়ার্ড' গ্রহণ করেছিলেন, সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমার মনে হয় আমি একজন ভণ্ড হওয়ার পথে ছিলাম তখন...আমার মধ্যে কপটতা ছিল। আমার মনে হয়েছিল, কেউ যদি মানুষ হত্যা করার জন্য মেডেল নিতে পারে; তাহলে গান গেয়ে আমি কেন পারবো না?"
যদিও তিনি এই অ্যাওয়ার্ড পরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এমনকি খ্যাতি লাভ করাকেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন তিনি, "মানুষ যে আমাদের এত পছন্দ করতো, আমরা তাতেই মজে গিয়েছিলাম। লোকের কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়ে আমরা যেন অন্য এক পথে হারিয়ে গিয়েছিলাম।"
সাক্ষাৎকারে সমালোচকদেরও এক হাত নিয়েছেন লেনন, "সমালোচকরা কখনোই শিল্পী হতে পারবে না। তারা শুধু প্রত্যাশা করতে পারে এবং বিচার করতে পারে...মানুষ গান নিয়ে লেখালেখি করে স্রেফ নিজের সময় নষ্ট করছে। আমি বুঝিনা, তাদের কেন লিখতে হবে?"
সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে ভেঙে যায় বিটলস। বিটলসের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তখন লেননকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "ট্যুর দেওয়া বন্ধ করার পর বিটলস আর কোনো পরিকল্পনা করেনি। বরং অন্যরা তাদের জন্য পরিকল্পনা করতো। এরপর যখন আর কেউ আমাদের জন্য পরিকল্পনা করেনি, আমরাও আর নতুন কিছু করিনি।"
লেননের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারের নিলাম অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর। আয়োজক প্রতিষ্ঠান, ওমেগা অকশনস এর পল ফেয়ারওয়েদার বলেন, "জন লেননের বুদ্ধিমত্তা ও বিভিন্ন ঘোষণা মিলিয়েই 'ভিনটেজ লেনন'। বিটলসপ্রেমীদের জন্য এই সাক্ষাতকার এক নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করবে, তাই এটি নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।"
এছাড়াও, চলতি সপ্তাহেই লেননের বিখ্যাত গান 'ইমাজিন' এর ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। এই উপলক্ষে গানের একটি লাইন 'ইমাজিন অল দ্য পিপল লিভিং লাইফ ইন পিস' শিরোনামে লন্ডনের সেন্ট পল'স গির্জা, বার্লিন ওয়াল এবং নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারসহ সারা বিশ্বে তা উদযাপিত হচ্ছে।
- সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান