আমি ডায়েরি লিখি না, কারণ সিনেমাই আমার ডায়েরি: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
শুক্রবার (৯ জুলাই) জি ফাইভে মুক্তি পাচ্ছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম ওয়েব সিরিজ 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন'। সিরিজটির শেষ মুহূর্তের কাজ নিয়ে তিনি তুমুল ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারই ফাঁকে কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে।
টিবিএস: জীবনের প্রথম ওয়েব সিরিজ। কেমন লাগছে আপনার?
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: আমি খুবই এক্সসাইটেড। আমরা যখন কোনো কাজ করি, সেটা যদি পোস্ট প্রোডাকশনের সময় বারবার দেখি, এর কারণ, কাজটা নিয়ে আমার নিজেরই আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ধরে নিই কাজটা দিয়ে মানুষকে স্পর্শ করার মতো ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন' নিয়ে এ রকম অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।
টিবিএস: 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেনে'র গল্প বাছাই করতে আপনি কোন বিষয়টা প্রাধান্য দিয়েছেন?
ফারুকী: সত্যি কথা বলতে, বছর দুয়েক ধরে চিন্তা করছিলাম সিরিজ করব। কিন্তু কোনটা করব, কী করব- এটা নিশ্চিত ছিলাম না। আমি অনেকগুলো গল্প নিয়ে গত দু'বছর কাজ করেছি। কমপক্ষে ১৫-২০টা তো হবেই। অনেক গল্প আছে, কিছুদূর এগিয়েছি, তারপর মনে হয়েছে বাদ দিই। এটা ভালো লাগছে না। এটা অবশ্য সব কাজের ক্ষেত্রেই হয়। কিন্তু এটা যেহেতু আমার প্রথম ওয়েব সিরিজ, তাই বোধহয় একটু বেশি বাছাবাছি করছিলাম। ফাইনালি আমি যখন এই গল্পটা পাই, তখন মনে হয় এটা করতে পারি।
এখন প্রশ্ন হলো, কী দেখে গল্পটা ফাইনাল করেছি?
সব গল্পের ক্ষেত্রে আমার একটা ক্রাইটেরিয়া আছে। সেটা হলো, কোন গল্পের চরিত্রগুলোর জটিলতাগুলো আমাকে টানছে। এই গল্পের যে প্রধান চরিত্র সাবিলা, তার যে ক্রাইসিস, সেটা আমাকে বেশি টেনেছে। এই গল্প সময়ের সাথে খুব রিলেভেন্ট। আমি সবসময় বলি, ফিল্মমেকিং অনেকটা আমার ব্যক্তিগত ডায়েরির মতো। আমি একটা সময়ে বসবাস করছি, একটা সময়ের জীবন যাপন করছি। আবার এই সময়ের পর আমি চলে যাব। আমি যখন যে সময়ের জীবন যাপন করি, সেই সময়ের চিহ্নটা আমার সিনেমার মধ্যে খোদাই করে যাই।
আমি প্রায়ই বলি, আমি ডায়েরি লিখি না; কারণ সিনেমাই আমার ডায়েরি। এই গল্পের মধ্যেও এই সময়ের রিলেভেন্ট আছে।
টিবিএস: সিরিজের প্রধান চরিত্র সাবিলা। চরিত্রটা সম্পর্কে জানতে চাই।
ফারুকী: শুরুতেই বলি, এটা সাবিলা নূর না! আমার চরিত্রের নাম সাবিলা হোসেন। অনেকেই ফেসবুকে এসে বলছেন, আপনি বলেছেন সাবিলা; কিন্তু এটা তো ফারিন... হা হা হা! যাই হোক, একজন স্ট্রং ওম্যান হিসেবে যদি বলা হয়, তাহলে ব্যাপারটা অনেকটা সাদাকালো হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, স্ট্রং উইমেনের কোনো দুর্বল দিক থাকতে পারে না। এরকম একটা ব্যাপার চলে আসে। এটা অনেক এনজিওর ইশতেহারের মতো মনে হয়। কিন্তু কোনো চরিত্রই তো এনজিও ইশতেহারের মতো হয় না। প্রতিটি চরিত্রের একটা লেয়ার থাকে। তবে সব লেয়ারের কনক্লুশন টেনে আমরা বলতে পারি, এটা একটা স্ট্রং ওম্যানের চরিত্র।
আমার সিনেমা বা টিভি প্রোডাকশনের মধ্যে স্ট্রং উইমেনের চরিত্র থাকে। এটার প্রধান কারন, আমি বড় হয়েছি আমার মা ও বড়বোনকে দেখে। বলতে পারি তারা স্ট্র উইমেন। এবং আমি প্রেম করেছি আরেক স্ট্রং উইমেন নুসরাত ইমরোজ তিশার সাথে। এই তিনজন স্ট্রং উইমেনের চিন্তার ছাপ আমার মধ্যে নিশ্চয়ে আছে। যেটার ছাপ আমার কাজের মধ্যেও পড়ে। সাবিলা হোসেন আর একটা স্ট্রং উইমেনের চরিত্র হিসেবে দর্শকদের মাঝে আসতে যাচ্ছে।
স্ট্রং উইমেন মানেই তো সবসময় রাগি, ক্ষমতাবান, ঘুষি মারে, এমন নয়। আমি বলতে চাইছি তারা আসলে ফাইটার। বাধা অতিক্রম করে। লাইক মাই মাদার, লাইক মাই স্টিস্টার এবং ওয়াইফ। সত্যিকার অর্থে অনেক বাধা অতিক্রম করেছে তারা। সাবিলা চরিত্রটাও এরকম।
আমাদের চারপাশে যে বাধার ফাঁদ পাতা আছে, সেটা অতিক্রম করবে সাবিলা হোসেন। সিরিজের আটটা পর্বের মাধ্যমে দর্শক যদি সাবিলা হোসেনের জার্নির সঙ্গে যান, তাহলে তারা একটা অন্যরকম অনূভূতি পাবেন।
টিবিএস: লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেনের দ্বিতীয় সিজন কি আসবে?
ফারুকী: 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন'কে আমি একটা রেগুলার ফ্রাঞ্জাইজিতে পরিণত করব। তবে সেটা একই চরিত্র নিয়ে হবে কি না, নিশ্চিত না। এমনও হতে পারে, 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টমেনে'র পরের গল্পটা নারী ও পুরুষের অন্য কোনো চরিত্রের দিক নিয়ে করলাম। আসলে নামটা দিয়েছিও ওই কারণে। নারী-পুরুষের চরিত্রের অনেক দিক থাকে। যেমন স্যোশাল, রোমান্টিক, পলিটিক্যাল। এই অ্যাঙ্গেলগুলো আমি হ্যান্ডেল করতে চাই 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন' গল্পের ম্যাধমে।
টিবিএস: যতদূর জেনেছি, এই সিরিজের বাজেট অনেক বেশি। সেটার পরিমাণ কি বলা যাবে?
ফারুকী: আমি ঠিক জানি না, কতটা বেশি হলে সেটাকে বেশি বলা যায়। অনেকটা 'কতটা পথ পেরুলে তবে পথিক বলা যায়'! আমি জানি না বেশি কি না। তবে আমার তো মনে হয় আরও বেশি বাজেট পাওয়া উচিত ছিল।
টিবিএস: ভালো কনটেন্ট নির্মাণের জন্য বাজেট বেশি জরুরি নাকি গল্প?
ফারুকী: এটার হার্ড অ্যান্ড ফাস্ট রুলস নাই। বাজেট দরকার, যদি শুটিংটা অনেক বেশি আয়োজন করে হয়। এটা যেমন সত্যি কথা, আবার এটাও সত্যি কথা, অনেক বেশি বাজেট একটা ভালো কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অল্প বাজেটেও অনেক ভালো সিনেমা নির্মিত হয়েছে। পৃথিবীতে অনেক উদাহরণ আছে।
টিবিএস: পরিচালক হিসেবে আপনি দারুণ জনপ্রিয়। 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন' ফারুকী বানিয়েছেন বলেই সবাই দেখবে? নাকি বিশেষ আরও কিছু আছে যেটার জন্য দেখা জরুরি?
ফারুকী: একেকজন একেক কারণে দেখবে। আমার পক্ষে আসলে বলা কঠিন। দিন শেষে কোনো গল্প বা চরিত্র যদি মানুষকে ছুঁয়ে যায়, তখনই সেটাকে মানুষ মনে রাখে। এটার ক্ষেত্রেও এরকম হবে আশা করছি।
টিবিএস: 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন' সিরিজে অনেক তারকার সমাবেশ ঘটিয়েছেন। প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, তারা অভিনয়ের জন্য অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছেন। পরিচালক হিসেবে আপনাকে কি কিছু বিসজর্ন দিতে হলো?
ফারুকী: সিরিজ করতে এসে অভিনেতা শরাফ আহমেদ জীবন চুল বিসর্জন দিয়েছেন। পার্থদাও (পার্থ বড়ুয়া) অনেক বছর পর চুল কেটেছেন। আমি নিজেও অনেক চুল বিসর্জন দিয়েছি। এটার সাক্ষী তিশা। তাছাড়া রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়েছি।
টিবিএস: করোনায় একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সামনের দিন ওটিটি প্লাটফর্মের রাজত্ব করবে বলে অনেকেই মনে করছেন। আপনার কী মনে হয়?
ফারুকী: সিনেমা হল সিনেমা হলের জায়গায় থাকবে। তবে পুরো বিশ্বের পাসপেকটিভে যদি বলি, ওটিটি একটা বড় মাধ্যম হতে যাচ্ছে। এটা আমি গত ৫ বছর আগে আমার ফেসবুকে লিখেছি। আমি একটা ছবি বানালাম, এটা যদি একসঙ্গে এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকাতে রিলিজ করতে চাই, তাহলে থিম পার্ক মুভি বা মার্ভেলে মুভি বানাতে হবে। এটা তো সম্ভব না। কিন্তু আমরা যারা ইন্ডিপেনডেন্ট মুভি বানাই, আবার এটা যদি চার মহাদেশে দেখাতে চাই, তাহলে কমপক্ষে পাঁচ বছর লাগবে। কিন্তু ওটিটি আলাদা। যেমন আমার এটা ৯ জুলাই পৃথিবীর সব জায়গা থেকে দেখতে পারবে। এত সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়াটা কিন্তু একটা দারুণ ব্যাপার।
ওটিটি একটা লাইব্রেরির মতো। এখানে যেমন ব্লকবাস্টার মুভি থাকছে, আবার ইনিপেনডেন্ট মুভিও থাকছে। যার যেটা ইচ্ছা দেখে নিতে পারছে। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, সামনে আমি কোন মাধ্যমে বেশি কাজ করব? আমি সানন্দে বলব, ওটিটিতে আমার কাজ বেশি দেখা যাবে।
টিবিএস: দুই বছরের বেশি সময় হলো 'শনিবার বিকেল' সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে। আপনাদের কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
ফারুকী: আমরা আপিল করেছি। সেটার ফলাফলের অপেক্ষা করছি।
টিবিএস: আপনার আরেকটা ছবি 'নো ল্যান্ডস ম্যান'। সেটার আপডেট কী?
ফারুকী: ওটার শুটিং শেষ। 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন' শেষ করে ওটার পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু করব।
টিবিএস: আপনি নাটক বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে সেটা নিয়ে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়। 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন' নিয়ে সেরকম কিছু হবে? কী মনে হচ্ছে আপনার?
ফারুকী: আমি কিভাবে বলব! আমি মনে করি, 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন' আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি।
টিবিএস: ফারুকীর কি গুরুত্বহীন কাজ আছে?
ফারুকী: এটা সব ফিল্মমেকারেরই থাকে হয়তো। কারণ, মানুষ ধীরে ধীরে নিজেকে পরিণত করে।
টিবিএস: যতদুর জানি, আপনি কবিতা লিখতে পছন্দ করেন। লেখেনও। কবি হিসেবে জনপ্রিয় না হওয়ার জন্য কখনো খারাপ লাগে?
ফারুকী: আমি তো মনে করি না, কবি হওয়া যায় না। কবি হয়ে ওঠার কিছু নাই। কেউ কবিতা লেখে শব্দে, কেউ পেইন্টিংয়ে। কেউ কিছু না লিখলেও জীবনযাপন হতে পারে কবির মতো। কবি তো একটা ধারণামাত্র। কবি কোনো বিশেষ কর্ম নয়। আমার এখন অজনপ্রিয় হতে ইচ্ছা করে। যেমন, আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আপনমনে, কেউ আমাকে চিনতে পারছে না; তাহলে মনে হয় বেশি ভালো হতো।