এগিয়েছে ওটিটি, পিছিয়েছে টিভি!
গত দু-তিন বছর ধরেই বদলে গেছে দেশের বিনোদন অঙ্গন। বিশেষ করে 'ছোট পর্দা' হিসেবে বিবেচিত টেলিভিশন মাধ্যম। দর্শক অনেকখানি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন টেলিভিশন মাধ্যম থেকে। উল্টো দিকে জনপ্রিয় হয়ে গেছে ইউটিউব থেকে ওটিটি প্লাটফর্ম। টেলিভিশন পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ- বাজেট স্বল্পতা, পরিকল্পনাহীন অনুষ্ঠান ও ওটিটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে না পারা। ইউটিউবে জনপ্রিয় হওয়া নাটকগুলো টেলিভিশনে প্রচার হলেও সেগুলোর ব্যবস্থাপনা টেলিভিশনের হাতে থাকে না। এজেন্সি বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বত্ব বিক্রি করে এখন চলছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।
গত দুই বছরে এ দেশের দর্শকদের টার্গেট করে চালু হয়েছে বেশ কয়েকটি ওটিটি প্লাটফর্ম। এ তালিকায় আছে হৈ চৈ, আড্ডা টাইমস, জি ফাইভ, সিনেমাটিক, ইরোজ নাউসহ বেশ কিছু। এসব ওটিটিতে বাংলাদেশি দর্শকেরা সহজেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সাবস্ক্রাইব করতে পারেন। যদিও এরমধ্যে বেশিরভাগ ওটিটির উত্থান ভারতে। দিন দিন তাদের সাবস্ক্রাইবার বাড়ছে । এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হওয়া ওটিটি প্লাটফর্ম নেটফ্লিক্সেও বাংলাদেশ থেকে সাবস্ক্রাইবার বাড়ছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে ভারতের ওটিটি প্লাটফর্ম আড্ডা টাইমস ও ইরোজ নাউ। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এলবিসি মিডিয়ার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে ব্যবসায়িক প্রসার ঘটাচ্ছে। শুরুর পর থেকেই তাদের সাবস্ক্রাইবার বাড়ছে বলে জানান এলবিসি মিডিয়ার হেড অব মার্কেটিং নুসরাত জারিন। তিনি বলেন, 'অফিসিয়ালী আমাদের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বলা নিষেধ। তবে শেষ চারমাসে আমাদের সাবস্ক্রাইবার বেড়েছে অনেক। চালুর পর থেকে আমরা বুঝেছি বাংলাদেশি দর্শকেরা আসলে ভালো কনটেন্ট দেখতে চায়। এ কারণেই আমরা বাংলাদেশি তারকাদের নিয়ে তিনটি নতুন কনটেন্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এসব কনটেন্টে কাজ করার জন্য এরইমধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তারিক আনাম খান, সাদিয়া জাহান মৌ ও অপর্না ঘোষসহ অনেকে'।
ওটিটিতে বাংলাদেশের সাবস্ক্রিপশন বাড়ছে এটা স্বীকার করলেন ভারতের আরেক ওটিটি প্লাটফর্ম হৈ চৈ বাংলাদেশের মার্কেটিং প্রধান সাকিব আর খান। তিনি বলেন, 'আমরা করোনার মধ্যেও চেষ্টা করেছি নতুন কনটেন্ট দেয়ার। বিশেষ করে ওরিজিনাল কনটেন্ট। এমনও হয়েছে ঘরে বসে শুটিং করেছেন তারকারা। এ কারণেই মানুষের বিনোদনের জায়গা হয়ে উঠেছে ওটিটি প্লাটফর্ম।'
তিনি সম্প্রতি হৈচৈ-এর সবচেয়ে হিট কনটেন্ট 'তাকদীর' এর কথা উল্লেখ করে বলেন, 'এই একটা কনটেন্ট দিয়ে আমরা বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সাবস্ক্রিপশন পেয়েছি। এইরকম কনটেন্ট দিতে পারলে সামনে একটা বড় সংখ্যক দর্শক টানতে পারবে ওটিটি। এ কারণেই আমরা আসলে কনটেন্টের মানের দিকে জোর দিচ্ছি।'
দেশীয় ওটিটি প্লাটফর্ম হিসেবে প্রায় তিন বছর আগে যাত্রা শুরু করেছে সিনেমাটিক অ্যাপ। তবে এটি আলোচনায় এসেছে সম্প্রতি। তাদের অ্যাপে এ বছরের শুরুতে মুক্তি পেয়েছে 'জানোয়ার' ও 'ট্রল' নামক দুটি ওয়েব ফিল্ম। এরপরই হু হু করে বাড়ছে সাবস্ক্রিপশন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক তামজিদ অতুল বলেন, 'আমরা শুরু থেকেই জোর দিয়েছি দেশীয় ভালো কনটেন্টের ওপর। এ কারণেই সাবস্ক্রিপশন বাড়ছে'।
আড্ডা টাইমস, হৈ চৈ ও সিনেমাটিক অ্যাপই শুধু নয়, গত বছর বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে বিঞ্জ, আরটিভি প্লাস, জি ফাইভ, লাগ ভেলকি। আরও কমপক্ষে তিনটি ওটিটি এ বছরই চালু হবে বলে জানা গেছে।
বেশ কয়েকজন ওটিটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় বিনিয়োগ প্রসঙ্গে। তবে কেউই নাম প্রকাশের শর্তে এই প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। জানা গেছে, প্রতিটি ওটিটির জন্য বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ ধরা হয়েছে গড়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ধাপে ধাপে এটি বিনিয়োগ করা হবে। এই বিনিয়োগের বড় অংশ ব্যয় হবে কনটেন্ট নির্মাণে আর প্রচারণায়।
বিনিয়োগ প্রসঙ্গে কথা বলেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আইয়ের উদ্যোগে চালু হতে যাওয়া নতুন ওটিটি চ্যানেল আই ওয়ার্ল্ড (সম্ভাব্য নাম) এর পরিচালক ও মার্কেটিং হেড ইবনে হাসান খান। তিনি বলেন, 'ওটিটি অনেক বড় বাজেটের বিষয়। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আমাদের বিনিয়োগ একশ কোটি টাকার কম হবে না। '
এদিকে ওটিটি প্লাটফর্মের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশীয় টেলিভিশনের নাটক এগোতে পারছে না বলে মনে করছেন অনেকে। অনেকে এ জন্য টেলিভিশন থেকে পাওয়া বাজেটকে দায়ী করেন। তবে বিষয়টির সঙ্গে একমত নন ইবনে হাসান খান। তিনি বলেন, 'দেশে যদি ৬০০ জন পরিচালক থাকে দেখবেন তাদের ভেতর ৫০ জন নিয়মিত কাজ করছে। তারা বাজেট নিয়ে কোন কথা বলছে না। যারা কথা বলছে তারা কোন কাজ করছে না। এখানে মেধার খানিকটা পার্থক্য আছে। আমরা মনে করি ভালো কাজের জন্য বাজেট কোন সমস্যা নয়। '
জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে অনুমোদিত ৪৫টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মধ্যে ৩০টি পূর্ণ সম্প্রচারে আছে। নিউজ চ্যানেল বাদ দিলে ২২টি চ্যানেল কাজ করে বিনোদন নিয়ে। এসব চ্যানেলে মাত্র দেড় লাখ টাকার কমে নির্মিত এক ঘন্টার নাটকও প্রচার হয় বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক জানান, যেসব টেলিভিশন চ্যানেল একসময় ৫-৬ লাখ টাকার নাটক নির্মাণ করতো এখন তারা এই সাহস দেখান না। তারা বেশিরভাগই নাটকের স্লট বিক্রি করে দেন। আমরা তাদের কাছে গেলে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে নাটক নির্মাণ করে দিতে বলেন। সিরিয়ালের রেট আরও কম। '
বাজেটের দিক থেকে ওটিটির সাথে পাল্লা দিয়ে টেলিভিশন চ্যানেল খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন নাগরিক টিভির অনুষ্ঠান প্রধান কামরুজ্জামান বাবু। তিনি বলেন, 'পুরো টিভি ইন্ড্রাস্ট্রি চলছে অপরিকল্পিতভাবে।একদিকে ভিউ-নির্ভর কনটেন্ট তৈরি, অন্যদিকে মানহীন কনটেন্ট। দুটোই অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছে টেলিভিশনকে। সামনে কি হবে সেটা অনিশ্চিত।'
এদিকে নিয়মিত নাটকে বাজেট কমে গেছে এবং এ কারণে দর্শক খানিকটা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে মনে করেন মাছরাঙা টিভির অনুষ্ঠান প্রধান আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, 'আসলে এখন অনেক দর্শক ও অনেক মাধ্যম। এ কারণে মনে হচ্ছে টেলিভিশন পিছিয়ে পড়েছে। আসলে তা নয়, টেলিভিশনের দর্শক এখনও আছে। ইউটিউব বা ওটিটিতে আমরা ভিউ হিসেবে জানতে পারি কতজন দর্শক দেখেছেন। কিন্তু টেলিভিশনে সেই সুযোগ নেই বা এখনও তৈরি হয়নি। আর আমাদের টেলিভিশন মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছু প্রচার হয় কিন্তু ইউটিউব বা ওটিটিতে দর্শক তার ইচ্ছামতো সময়ে দেখতে পারেন। এটাও একটা বড় কারণ। তবে এসব কারণে টেলিভিশন পিছিয়ে পড়বে এমনটা নয়। টেলিভিশন তার মতো করেই এগোবে।'
টেলিভিশন নাটকের প্রযোজকদের সংগঠন টেলিভিশন গ্রোগ্রাম প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসির বলেন, 'প্রতি বছর যে নাটক নির্মাণ হয় সে তুলনায় গতবছর করোনায় প্রায় ৭০ ভাগ কমে গিয়েছে। যেগুলো নির্মিত হয়েছে সেগুলোও সব মানসম্মত নয়। আর বাজেটও সেরকম পাওয়া যায় না। সরাসরি টেলিভিশন কোন নাটক নির্মাণ করে না। '
২০১৯ সালের নভেম্বরে অভিনয়শিল্পী সংগঠনের আয়োজিত এক সেমিনারে দেশের টিভি নাটকের মানের অবনতির জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে দায়ী করেছিলেন অভিনয়শিল্পীরা।
টিভি নাটকের দুরবস্থার কারণ হিসেবে সেখানে উল্লেখ করা হয়, টেলিভিশন ও টেলিভিশন নাটককে শিল্প ঘোষণা না করা, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব, নাটকের মান নিয়ন্ত্রণে চ্যানেলের ব্যর্থতা কিংবা উদাসীনতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ, নাটকের মূল্য কমে যাওয়া, নাটকের চরিত্রাভিনেতাদের হারিয়ে যাওয়া প্রভৃতি।
তবে টেলিভিশন সংশ্লিষ্ট অনেকেই আশা করছেন, টিভির সুদিন ফিরবে। পাশাপাশি ওটিটি এগিয়ে যাবে বলেও কারো কারো মত।