ব্র্যাড পিট, জেরাড লেটোর মতো তারকারা কেন 'পুরুষদের বিউটি ব্র্যান্ড' চালু করছেন?
হলিউড-বলিউড থেকে শুরু করে সঙ্গীত ও ক্রীড়া জগতের তারকাদের নিজস্ব বিউটি ব্র্যান্ড বা প্রসাধনী ব্র্যান্ড চালু করা নতুন কিছু নয়। রিয়ানার ফেন্টি বিউটি, লেডি গাগার হাউস ল্যাবস, কিম কার্দাশিয়ানের এসকেকেএন, সেলেনা গোমেজের রেয়ার বিউটি থেকে শুরু করে এমন আরো অসংখ্য ব্র্যান্ডের নাম পাওয়া যাবে সৌন্দর্য্যের জগতে। কিন্তু এত বছর যাবত তারকাদের এসব ব্র্যান্ড ছিল শুধুই নারীকেন্দ্রিক। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রথা ভেঙে দিয়ে বিশ্বখ্যাত তারকারা নিয়ে আসছেন তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড- পুরুষদের জন্য।
ত্বকের যত্ন ও প্রসাধনী পণ্যের ক্ষেত্রে ২০২০ সালে আমেরিকান র্যাপার-গায়ক ফ্যারেল উইলিয়ামস তার নিজস্ব ব্র্যান্ড 'হিউম্যানরেস' বাজারে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে, ২০২১ সালে ইংলিশ গায়ক হ্যারি স্টাইলসের ব্র্যান্ড 'প্লিজিং' আত্মপ্রকাশ করে। এর মাধ্যমে শীর্ষ সারির পুরুষ তারকাদের মধ্যে নিজ নিজ ব্র্যান্ড চালু করার হিড়িক পড়ে যায়- এবং এর মাধ্যমে তারা বিপুল পরিমাণ টাকা আয়ও করছেন। আর যেহেতু তারকাদের ব্র্যান্ড, তাই স্বভাবতই তাদের পণ্যের মধ্যে তাদের সৌন্দর্য্যের রহস্যের সন্ধান পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ!
২০২২ সালে বেশকিছু ব্র্যান্ড আত্মপ্রকাশ করে- ইদ্রিস এলবা ও তার স্ত্রী, মডেল সাবরিনা ডওরে এলবা মিলে স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড "এস'অ্যাবল ল্যাবস" চালু করেন গত বছরের জুলাইয়ে। তারপর সেপ্টেম্বরে ট্র্যাভিস বার্কার- সম্ভবত তার নববধূ কোর্টনি কার্দাশিয়ানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তার ওয়েলনেস ব্র্যান্ডে 'সিবিডি-যুক্ত' স্কিনকেয়ার পণ্য যোগ করেন।
এর পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জেরাড লেটো ও উদ্যোক্তা জোনাথন কেরেন মিলে যৌথভাবে 'টুয়েন্টিনাইন পামস' নামের একটি ব্র্যান্ড চালু করেন। অন্যদিকে, হলিউড অভিনেতা ব্র্যাড পিট তার অ্যান্টি-এজিং কালেকশন 'লে ডোমেইন' এর ঘোষণা দেন। ওয়াইন প্রস্তুতকারী মার্ক পেরিনের সাথে কোলাবরেশন করে তিনি এই স্কিনকেয়ার পণ্য নিয়ে আসেন।
তারকাদের এসব ব্র্যান্ড বা নতুন পণ্য নিয়ে আসার বিষয়টি মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করেছে- বিশেষ করে পণ্যগুলোর উচ্চমূল্যের কারণে। জেরাড লেটোর ব্র্যান্ডের ছোট্ট একটি আই ক্রিমের দাম ৯৭ ডলার, ব্র্যাড পিটের অ্যান্টি-এজিং সিরামের দাম ৩৭০ ডলার! কিন্তু তবুও এগুলো এমন একটি সময়ে বাজারে এসেছে যখন পুরুষদের প্রসাধনী পণ্যের চাহিদা তরতর করে বাড়ছে।
ফিউচার মার্কেট ইনসাইটস-এর গত বছরের জুলাইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে পুরুষদের প্রসাধনী খাতের বৈশ্বিক মূল্য ছিল ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৯ সালের মধ্যে এটি আনুমানিক ২৮.৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।
ডিজিটাল বিউটি পাবলিকেশন 'ভেরি গুড লাইট' এর লেখক ও পারসোনাল কেয়ার ব্র্যান্ড 'গুড লাইট কসমেটিকস'-এর প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড ইয়ে বলেন, "আমার মনে হয় 'পুরুষদের বিউটি ব্র্যান্ডের উত্থান- বিশেষ করে তারকাদের প্রতিষ্ঠিত যেগুলো- এর উত্থানের কারণ হচ্ছে সৌন্দর্য্যের ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যবধান রয়েছে, যেটা সবসময়ই ছিল।"
প্রসাধনী ও স্কিন কেয়ার পণ্যের কোনো লিঙ্গ নেই- এই ধারণা বর্তমানে আরও জোরদার করার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন জনপ্রিয় ইউটিউবার ও ননবাইনারি ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সাররা। এদের অনেকেরই এখন নিজস্ব ব্র্যান্ড রয়েছে- কিন্তু পণ্যের প্রচারণার সময় তারা এগুলোকে শুধুমাত্র 'পুরুষদের সাজসজ্জার পণ্য' বলতে নারাজ। সবার জন্য পণ্য সহজলভ্য করে তোলা একটি দারুণ ব্যবসায়িক কৌশল। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ায় কে-বিউটি পণ্যগুলো গত দুই দশক ধরেই পুরুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পশ্চিমারা এই ট্রেন্ডে যুক্ত হয়েছে আরও পরে।
খ্যাতনামা ব্র্যান্ড ক্লিনিক তাদের আলাদা স্কিনকেয়ার লাইন 'ক্লিনিক ফর মেন' এর ক্যাম্পেইন শুরু করে ২০১৫ সালে। অন্যদিকে, শ্যানেল তাদের নতুন কসমেটিকস লাইন 'বয় ডি শ্যানেল' চালু করে ২০১৮ সালে।
সংশয়ের হাওয়া
সময়ের সাথে সাথে সৌন্দর্য্য চর্চার সংস্কৃতি বদলেছে, স্কিন কেয়ার পণ্য-প্রসাধনী ব্যবহারের ধরনও বদলেছে। 'জেন্ডারলেস' কালেকশন, অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো লিঙ্গের মানুষের ব্যবহারের জন্য সীমাবদ্ধ নয়- এমনটাই পণ্যের মধ্যে আশা করেন ক্রেতারা।
ডেভিড ইয়ের ভাষ্যে, "সৌন্দর্য্য সংক্রান্ত পণ্য এখন হট মার্কেট। ফেন্টি বিউটি ব্র্যান্ডটি নিয়ে রিয়ানা কী কী করেছেন তা মানুষ দেখেছে... আমার মনে হয় অনেক তারকাই এখন এই ট্রেন্ডে যোগ দিতে বেশ আগ্রহী; কারণ এটি খুবই কার্যকরী একটি ব্যবসা। কিন্তু যেহেতু বাজারে প্রচুর ব্র্যান্ড রয়েছে, তাই এটি খুব চ্যালেঞ্জিংও।"
ডেভিড মনে করেন, এখন তারকাদের ব্র্যান্ডের নাম শুনলে মানুষের মনে একটু সংশয়ও তৈরি হয়... আর সেটা মোটেও অযৌক্তিক কিছু নয়। কারণ ভোক্তারা জানতে চায়, এই ব্র্যান্ডটির মানে কী? এটি কেন তাদের জন্য দরকারি?"
পপ তারকা রিয়ানার ফেন্টি বিউটির কথাই ধরা যাক, ফেন্টি ৪০টি শেডের ফাউন্ডেশন বাজারে এনে বিখ্যাত হয়ে যায়। বিভিন্ন গাত্রবর্ণের মানুষদের জন্য তারা ফাউন্ডেশনের রঙ মিলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে।
হেইলি বিবারের 'রোড' খুবই মিনিমাল, ডিউয়ি লুক তৈরির কথা প্রমোট করে এবং আল্যুর বেস্ট বিউটি অ্যাওয়ার্ডও জিতেছে। মেশিন গান কেলির নেইলপলিশ ব্র্যান্ড ইউএন/ডিএন ল্যাকর ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উইলিয়ামের 'হিউম্যানরেস' ব্র্যান্ড মোটামুটি সাশ্রয়ী মূল্যে ভোক্তাদের স্কিনকেয়ার পণ্য কেনার সুযোগ দিচ্ছে।
এদিকে লে ডোমেইন, টুয়েন্টিনাইন পামস ও বার্কার ওয়েলনেস এখনো নিজেদের ব্যবসার বিক্রিবাট্টা সম্পর্কে মুখে তালা দিয়েই আছে। তবে সিএনএন এর অনুরোধের জবাবে ইমেইল করে বলা হয়েছে, লে ডোমেইন এখন আউটলেটগুলোতে খুচরা বিক্রয়ের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
ডেটা অ্যানালিটিক্স কোম্পানি লঞ্চমেট্রিকস এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মিডিয়া ইমপ্যাক্ট ভ্যালু (এমআইভি) বিবেচনায় অনলাইনে লে ডোমেইন ব্র্যান্ডের ভ্যালু সবচেয়ে বেশি। অনলাইনের রিচ থেকেই ৫.৮ মিলিয়ন ডলার গেছে তাদের পকেটে। ব্র্যাড পিটের কোনো অফিসিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট না থাকার পরেও এবং প্রচারণায় খুব কম ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও এই জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার ব্র্যান্ড। কিন্তু বিপরীতে জেরাড লেটো নিজ ব্র্যান্ডের প্রচারণায় বেশ অ্যাক্টিভ। কোম্পানির মোট এমআইভির ৪০% এসেছে অভিনেতার পোস্টগুলো থেকে।
হ্যারি স্টাইলসের সোশ্যাল মিডিয়া রিচ অনেক বেশি থাকলেও তিনিও পিটের মতোই সক্রিয় নন। তার ব্র্যান্ড 'প্লিজিং' বাজারে আসার প্রথম বছরে বেশ সফলতাও পেয়েছে। লঞ্চমেট্রিক্সের ডেটা অনুযায়ী, ২০২১ সালে নভেম্বর থেকে শুরু করে ব্র্যান্ডের মিডিয়া ইমপ্যাক্ট ভ্যালু দাঁড়িয়েছে ৬১.৩ মিলিয়ন ডলারে; এর মাত্র ৩ শতাংশ এসেছে হ্যারির নিজ পোস্টগুলো থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্র্যান্ডের নিজস্ব প্রচারণা থেকেই বেশিরভাগ আয় হয়েছে তাদের।
ব্র্যান্ড ও মানুষের সাথে সম্পৃক্ততা
বিখ্যাত তারকাদের ব্র্যান্ড চালু হওয়া মানেই মানুষের আগ্রহ থাকে তুঙ্গে। কিন্তু সেই সাথে পণ্যের দাম, মান এবং ব্র্যান্ডের সত্যতা যাচাইয়ের মতো ফ্যাক্টর থাকে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠাতাদের অবশ্যই তাদের হোমওয়ার্ক করেই মাঠে নামতে হবে বলে মনে করেন ডেভিড ইয়ে। যেমন- ব্র্যাড পিট ও লেটো দুজনেই বিউটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে তাদের তেমন জানাশোনা নেই বলে স্বীকার করেছেন বিভিন্ন সাক্ষাতকারে। পিট স্কিনকেয়ারের জগতে নিজেকে 'একজন পর্যটক' এবং লেটো নিজেকে 'ছাত্র' বলেই আখ্যা দিয়েছেন।
তবে লেটোর এক মুখপাত্র জানান, অভিনেতা নিজে বিভিন্ন পণ্যের পরীক্ষা ও ট্রায়ালে উপস্থিত থাকেন এবং পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করে নিজের মতামত দেন এবং টিমের বাকিদের নিয়ে কাজ করেন।
অন্যদিকে, পিট তার ব্র্যান্ডের দর্শন ঠিক করে দিয়েছেন। অভিনেতা বলেছেন, "প্রকৃতিতে কোনোকিছু ফেলনা যায় না। যা কিছু ফেলে দেওয়া হয় তা আবার খাদ্য বা অন্যকিছুতে রূপান্তরিত হয়।" এটাই তার ব্র্যান্ডের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বছর ধরে তিনি বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন এবং পণ্যের ডিজাইন প্রক্রিয়ার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত আছেন।
আল্যুর এর এক্সিকিউটিভ বিউটি ডিরেক্টর জেনি বেইলি মনে করেন, অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠাতা যা করেন, একজন সৌন্দর্য্য-সংক্রান্ত পণ্যের প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকেও একই জিনিস আশা করেন ভোক্তারা- তা হলো একটি কমিউনিটি তৈরি ও সমস্যা সমাধান।
তবে ডেভিড ইয়ে মনে করেন, "বর্তমানে এত এত ব্র্যান্ড রয়েছে বিশ্বে এবং অনেক কমিউনিটি রয়েছে যাদের কাছে এদের সেবা পৌঁছাচ্ছে না। তাই বিখ্যাত তারকারা নিত্যনতুন ব্র্যান্ড চালু না করে, ইতোমধ্যেই যেসব ব্র্যান্ড আছে সেগুলোকে সহায়তা করলে, সমর্থন দিলে সবচেয়ে ভাল হয়।"
সূত্র: সিএনএন