মাত্র আট শব্দের টেলিগ্রামে মনসুর আলী খান পতৌদি ও শর্মিলার প্রেম বিয়েতে গড়ায়!
ভারতীয় অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর এবং ভারতীয় ক্রিকেটার ও পতৌদির নবাব মনসুর আলী খানের প্রেমের গল্প যেন ভারতের চলচ্চিত্রে জগতে এক রূপকথার মতো। বর্তমানকালে হরহামেশাই বলিউড অভিনেত্রীদের ডেট করে থাকেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা। কিন্তু শর্মিলা ঠাকুর আর মনসুর আলী খানের প্রেম অতটা সহজ ছিল না। দুজন দুই ভুবনের বাসিন্দা; একজন চাকচিক্যময় সেলুলয়েড জগতের, আর অন্যজন খেলার মাঠ দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন। পেশাগত ভিন্নতা এবং ক্যারিয়ারের শীর্ষে থেকে চরম ব্যস্ততা সত্ত্বেও, কোনো এক জাদুবলে যেন পতৌদির নবাবের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন 'সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা'!
তবে মধ্যবয়সে পা রাখার পর থেকে নিজের অতীত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমের সামনে বলতে দ্বিধা করেননি এই অভিনেত্রী। তখনই জানা গেছে, নিছক কাকতালীয় নয়, বরং ক্রিকেট ভালোবাসতেন বলেই মনসুর আলী খানের সঙ্গে প্রণয়ে জড়িয়েছিলেন তিনি।
মনসুর আলী খানের ডাকনাম ছিল টাইগার। শর্মিলার ভাষ্যে, "টাইগারের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে থেকেই আমি একদম ক্রিকেটপাগলা ছিলাম।" সে কারণেই কি নিজের আশেপাশে থাকা গ্ল্যামার জগতের পুরুষদের দিকে আগ্রহী হতে পারেননি শর্মিলা? চাকচিক্যময় পার্টির বদলে ক্লাব-প্যাভিলিয়ন, স্টেডিয়ামই তাকে আকর্ষণ করেছিল বেশি! আর তাছাড়া, কলকাতাবাসীদের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার তো তুলনাই হয় না!
তবে কিছু কিছু ক্রিকেটার জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাকিদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। জয়সিমহা, বন্ধুদের কাছে যিনি জয় নামে পরিচিত; সে সময়কার ক্রিকেটপাগল প্রতিটি টিনেজারের স্বপ্নের নায়ক ছিলেন তিনি। আর জয়ের বন্ধু হিসেবে মনসুর আলী খানের প্রেমে পড়া যেন অনিবার্যই ছিল শর্মিলার! তবে সমসাময়িক অন্যান্যদের চেয়ে পতৌদি ছিলেন একটু আলাদা। খুব মিতভাষী ছিলেন, কিন্তু যখন কথা বলতেন তা মুগ্ধ হয়ে শুনতে হতো। শান্ত, ঠান্ডা মেজাজের এই মানুষটি ছিলেন যেন এক প্রহেলিকা!
টাইগার পতৌদির সঙ্গে শর্মিলার দেখা হয়েছিল ১৯৬৫ সালের দিকে, বম্বে এবং কলকাতায়। তৃতীয়বার যখন তাদের দেখা হয়, সারাটা সন্ধ্যা কাটিয়েছিলেন কলকাতার এক রেস্টুরেন্টে। আর সেদিন সন্ধ্যায়ই রিংকু (শর্মিলা) এবং টাইগার নিজেদের ফোন নম্বর আদান-প্রদান করেন।
শর্মিলা বলেন, "আমি শশী কাপুর ও রাজ কুমারের সঙ্গে একটা গানের দৃশ্যের শ্যুটিং এর জন্য নৈনিতাল যাচ্ছিলাম। যাত্রাপথে দিল্লিতে থামতে হয়েছিল। দিল্লির ইম্পেরিয়াল হোটেলে উঠে আমি টাইগারকে কল দিলাম। তাকে ফোনে না পেয়ে ওই সপ্তাহে ভারতের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করার জন্য অভিনন্দন বার্তা জানিয়ে রাখলাম। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল... ওই পর্যন্ত এটুকুই ছিল।"
এর দুই মাস পরে শর্মিলার বম্বের হোস্ট ধীরা জানালেন, পতৌদি কল করেছিলেন এবং তিনি শর্মিলা ঠাকুরের পুরো ঠিকানা নিয়েছেন। কারণ টাইগার শর্মিলার জন্য পাঁচটি ফ্রিজ কিনেছেন এবং এখন সেই ডিলার ফ্রিজগুলো ডেলিভারি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এদিকে এই খবর শুনেই আকাশ থেকে পড়েন শর্মিলা- 'আমি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম! সাথেসাথে টাইগারকে কল দিয়েছিলাম।" আর বাকিটা ইতিহাস!
দুজনেই খ্যাতনামা ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হওয়ায় এবং দুজনেই প্রচুর ভক্ত-অনুরাগী থাকায়ই হয়তো তাদের মধ্যে সংযোগ তৈরি হওয়া সম্ভব হয়েছে। কাজের চাপ, শিডিউল মেলানোর পাশাপাশি দুজনেই ক্যারিয়ারে খ্যাতির শিখরে ছিলেন তখন, তবুও এর বাইরে নিজেদের জন্য সময় বের করেছেন। ক্রিকেটারদের মধ্যে শর্মিলার বন্ধুবান্ধব ছিল এবং টাইগারের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথেও দেখা করতেও ভালোবাসতেন তিনি... যা তাকে সাহায্য করেছিল। কারণ গ্ল্যামারের জগতের সঙ্গে মনসুর আলী খানের কোনো যোগাযোগ ছিল না এবং পরবর্তীতেও তিনি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হননি।
ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে ম্যাচ খেলতে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতে হতো মনসুর আলী খানকে। আর এই শিডিউল পরিবর্তনের সুযোগও তার হাতে ছিল না। আর শর্মিলারও একের পর এক ছবি হিট হচ্ছিলো, তাই নিজের শ্যুটিং ফেলে বা যখন-তখন শিডিউল বদলে প্রযোজক-পরিচালক বা সহ-তারকাদের বিপদে ফেলার মনমানসিকতাও তার ছিল না। শর্মিলাও জানতেন যে তিনি কোন খেলায় লিপ্ত হয়েছেন!
তবে এরই মধ্যে দুজনের প্রেম বহাল থাকে, তবে খুব গোপনে...এবং ঝঞ্ঝাপূর্ণ না হলেও কিছুটা তামাশার সঙ্গেই! একবার টাইগারের সঙ্গে তার ম্যাচ দেখতে ব্রিটেনে উড়ে গিয়েছিলেন শর্মিলা; সেখানে তিনি সবার সঙ্গে শর্মিলাকে তার বোন হিসেবে পরিচয় দেন! কারণ কোনোভাবেই নিজেদের আসল সম্পর্ক প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। অন্যদিকে, বম্বেতে নিজের বন্ধু ধীরার বাড়ি থেকে চুপিসারে বেরিয়ে তাজ হোটেলে চলে আসতেন শর্মিলা, যাতে করে আশেপাশে বন্ধুদের চেঁচামেচি-টিপ্পনি ছাড়াই তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন টাইগার। এমনকি মাঝেমধ্যে ধীরাকে না বলে তাজ হোটেলে থেকেছেনও তিনি! এভাবে চুপিচুপি দেখাসাক্ষাৎ করতে মাঝেমধ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিতে হতো যা দুজনে বেশ উপভোগ করতেন।
সিনেমার জগত ছিল ক্রিকেটের মতোই উন্মাতাল। চারদিকে হইচই, ভক্তদের আনাগোনা, গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া! কোনো নায়িকার প্রেমের খবর পেলেই যে মিডিয়াগুলো হামলে পড়বে তা একেবারে নিশ্চিত ছিল। 'সাভান কি ঘটা'র পর পরিচালক শক্তি সামন্তর আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা নিয়ে আসেন। তিনি ইউরোপিয়ান লোকেশনে একটি ছবি শ্যুট করতে চান, যেখানে শর্মিলা ঠাকুরকে দেখা যাবে আরও অভিজাত লুকে। 'অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস' টাইটেলের এই সিনেমার নামকরণ করা হয়েছে একটি ফরাসি পারফিউম থেকে। যখন হাতেগোনা কয়েকটি বিদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পেরেছিল, সেই সময়ে ভারতীয় বাজারে এসেছিল এই পারফিউম। ছবির নাম, কলাকুশলী, লোকেশন- সব মিলিয়ে এক মহোৎসব!
বৈরুতে ছবির শ্যুটিং এর সময় সুইমিং পুলের একটি সিকোয়েন্সে শর্মিলা ঠাকুরকে বিকিনি পরে শ্যুট করতে হয়েছিল। তাকে দেখানো হয়েছিল এমন এক ভারতীয় নারী রূপে যে কিনা নিজের সৌন্দর্য প্রকাশে কুণ্ঠাবোধ করে না। পরবর্তীতে বিকিনি পরা শর্মিলার এই ছবি ফিল্মফেয়ার কভারে বিশালাকারে ছাপা হয়। ১৯৬৭ সালে ভারতে এমন দৃশ্য যেন সবাইকে হতবাক করে দেয়!
একই সাথে ছবিটি দিয়ে যেমন সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন শর্মিলা, তেমনই তাকে নিয়ে সমালোচনা, গসিপ ও নিন্দার ঝড়ও উঠেছিল। এমনকি তাকে সিনেমা থেকে নিষিদ্ধের আশঙ্কাও ছিল। যেহেতু এটা হলিউড ছিল না, বরং ষাটের দশকের ভারত ছিল; তাই সেসময়কার সিনেমা মুক্তির আগে কোনো 'প্যারেন্টাল গাইড' দেওয়া হতো না; কিংবা 'শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য' বলে কোনো ঘোষণাও দেওয়া হতো না বললেই চলে। তাই শর্মিলার এই সাহসী অবতার মেনে নিতে পারেননি অনেকেই।
'স্বল্পবসন বিকিনিতে ভারতকে চমকে দিলেন শর্মিলা', 'কভার গার্ল নাকি আনকভার গার্ল'- এ ধরনের শিরোনামে ছেয়ে গিয়েছিল সংবাদপত্রের পাতা। কেউই অভিনেত্রীর এই কাজকে ভালো চোখে দেখেননি তখন। ভারতজুড়ে এই তোলপাড়ের খবর যখন শর্মিলার কাছে পৌঁছায়, তিনি একেবারে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। ইউরোপে শ্যুটিং চলাকালেই এই খবর পেয়েছিলেন তিনি। "আমি খবরটা শুনে রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিলাম। অকারণে এত হইচই তো কোনোভাবেই মানা যায় না!" বলেছিলেন শর্মিলা।
এসময় মনসুর আলী খান পতৌদি ওরফে টাইগার শর্মিলার কাছাকাছি ছিলেন না। তবে শর্মিলার সেই আবেদনময়ী ছবি তার নজর এড়ায়নি। সাসেক্সে টুর্নামেন্ট খেলতে খেলতে শুধু আট শব্দের একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন প্রেমিকাকে। ইংরেজিতে লিখেছিলেন- Relax! You could only be looking very nice." যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- "শান্ত থাকো! তোমাকে শুধু অসম্ভব সুন্দর লাগছে।" (আলোচিত সেই ছবিটিতে)
টাইগারের এই কথা শুনে শর্মিলা শান্ত হন এবং বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। তবে একই সাথে এই সময়েই শর্মিলা উপলব্ধি করতে পারেন যে, টাইগারের এই ঠান্ডা, 'কুচ পরোয়া নেহি' মেজাজ তার মধ্যে খুবই সহজাত। শর্মিলা এবং তার নিজের সম্পর্কে তার যে আত্মবিশ্বাস, সেটিই যেন তার এই আট শব্দের ইংরেজি টেলিগ্রামে প্রকাশ পেয়েছিল। এরপর থেকেই শর্মিলা টাইগারের ওপর ভরসা করতে শুরু করেন এবং দুজনের প্রেম আরও গভীর হয়। অভিনেত্রীর ভাষ্যে, "সে (টাইগার) এই পরিস্থিতিতেও নিজেকে নিয়ে নিশ্চিত ছিল- আমাকে নিয়ে-আমাদেরকে নিয়েও! আমি এরকম উদ্দাম, দুঃসাহসী ভাব আগে কখনো অনুভব করিনি।"