‘কারার ওই লৌহকপাট’: দুই বাংলায় তোপের মুখে এ আর রহমান
কিছুদিন আগেই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজনে মুক্তি পেল যুদ্ধভিত্তিক হিন্দি সিনেমা 'পিপ্পা'। সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই সিনেমায় উঠে এসেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের ঘটনা।
মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করতে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বালরাম সিং মেহতা। ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হলেও এই সিনেমা নিয়ে এদেশের আলোচনা এ আর রহমানের সঙ্গীতায়োজনে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান 'কারার ওই লৌহকপাট' নিয়ে।
গানটি ইউটিউবে মুক্তির পর থেকে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে বাংলাদেশের মতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতো তারকারাও এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন। এর কারণ গানের সুর।
১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও সুর করা এই গান বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় সৃষ্টি। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীদের কারারুদ্ধ হওয়ার প্রতিবাদ থেকে নজরুল লিখে ফেললেন 'কারার ওই লৌহকপাট'।
এই কালজয়ী গান পরবর্তীতে আবারও তুমুল জনপ্রিয়তা পায় ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের পরিচালনায় 'জীবন থেকে নেয়া' সিনেমা দিয়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রক্ত গরম করা গান 'কারার ওই লৌহকপাট'। দেশকে মুক্তি করতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণ যোগাত এই গান। তার কারণ যেমন গানের কথা তেমনি এর দরাজ সুর।
বাঙালি শ্রোতা এখনও 'কারার ওই লৌহকপাট' শুনে আন্দোলিত হয়। কিন্তু এ আর রহমানের গানটিতে নতুন সুর যেন তাই আর প্রশংসার যোগ্য তো হলোই না বরং বিতর্ক এখন তুঙ্গে।
বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নজরুল সংগীত সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল।
আনুষ্ঠানিক এক ভিডিও বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'এই গান বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় রচিত। মুক্তিযুদ্ধে সময়ও গানটি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়েছিল। আর সেই গানের সুর বদল করে ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত সুরকার খুবই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'কীভাবে তিনি এই গানকে নতুনভাবে সুরারুপ করেছেন। এই কাজটি করে তিনি আমাদের কাজী নজরুল ইসলামকে অসম্মান তো করেছেনই এবং প্রতিটি বাঙ্গালীর মনে আঘাত করেছেন। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।'
এ আর রহমানকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের নজরুল সংগীতশিল্পী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদ।
গণমাধ্যমে তিনি বলেন, 'কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত সৃষ্টি এই গান। সেই সঙ্গে বাঙালির আবেগ। তাই সব নজরুল সংগীতশিল্পীদের একত্র হয়ে এর প্রতিবাদ জানানো উচিৎ। এ আর রহমানের মতো একজন শিল্পী গানটির সুর বিকৃতি কেন করবেন?'
সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদার ইউএনবিকে বলেন, 'অন্য অনেকের মতো এ আর রহমানের ভক্ত আমিও। তবে এই কাজটি নিয়ে হতাশা ছাড়া কিছু দেখছি না। তবে শুধু এ আর রহমান নয় গানটির সঙ্গে জড়িত আরো যারা আছেন তাদেরও দায় নিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'ফেসবুক খুলে এ রকম একটা কাজ দেখে আমি নিজেও ক্ষুব্ধ। আমার ধারণা, এ আর রহমানকে এককভাবে দায়ী না করে, এর সঙ্গে ক্রিয়েটিভ টিমে যারা ছিলেন, তাদেরকেও দায়ী করতে হবে। যারা গানটি নির্বাচন করেছেন তারা নিশ্চয় গানটি সম্পর্কে জানেন এবং খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত এর সঙ্গে বাংলা ভাষার লোকজনও আছে।'
কলকাতার সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারে সেখানকার গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা এর প্রবিবাদে তাদের মন্তব্য জানিয়েছেন।
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী বললেন, 'আমার ভালো লাগেনি। ওর (এ আর রাহমান) মতো অত্যন্ত সুপরিচিত সুরকারের কাছে আমরা এটা আশা করি না। সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানো উচিৎ।'
অজয় চক্রবর্তী মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলনায় কাজী নজরুল ইসলামের পরিচিতি কম হয়ে থাকার নেপথ্যে দায় বাঙালি জাতির। তার কথায়, 'আমরা ওর (কাজী নজরুল ইসলাম) সম্পর্কে ততটা জানি না। কিন্তু সংগীতের বহু ক্ষেত্রে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তুলনায় নজরুল ইসলামের অবদান বেশি।'
ভারতের বর্ষীয়ান সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লাও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, 'বাংলার সংগীত নিয়ে যে ওর (রাহমান) কোনও ধারণা নেই, সেটাই বুঝতে পারলাম। বাঙালি সংস্কৃতিকে এরা ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে।'
'কারার ওই লৌহকপাট' সিনেমায় নতুনভাবে আয়োজন করেছেন এ আর রহমানসহ একাধিক বাঙালি গায়ক। তারা হলেন- তীর্থ ভট্টাচার্য, রাহুল দত্ত, পীযুষ দাস, শালিনী মুখোপাধ্যায়।