ছিলেন কেরানি; ‘ভয়ানক’ চেহারার জন্য কাজ পাননি বলিউডের সবচেয়ে ‘সফল’ ভিলেন ‘মোগ্যাম্বো’; পরে নায়কদের চেয়ে বেশি ধনী হন
পর্দায় তিনি হাজির হতেই ভয়ে গা শিরশির করে ওঠে বহু দর্শকের। তিনি বলিউডের সবচেয়ে 'সফল' ভিলেন অমরীশ পুরী। হতে চেয়েছিলেন নায়ক, কিন্তু শেষতক হয়ে ওঠেন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে সফল ভিলেন।
জলদগম্ভীর কণ্ঠ, বড় বড় চোখ আর কুঁচকানো কপাল দিয়ে তিনি নায়ক-নায়িকা ও ভক্তদের মনে ভয়ের সঞ্চার করতেন। মোগাম্বো, দুর্জন সিং, বাবা ভৈরোনাথ—একেকটি অবিস্মরণীয় খলচরিত্র দিয়েই তিনি বলিউডে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন।
নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৫৩ সালে ২১ বছর বয়সে প্রথম স্ক্রিন টেস্ট দেন অমরীশ পুরী। কিন্তু 'রুক্ষ' চেহারা ও 'ভীতিকর' চেহারার জন্য প্রথম দেখাতেই তাকে বাতিল করে দেন পরিচালক।
চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবেন্দ্র গোয়েল অমরীশকে বলেন, 'তুমি কখনও নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে না।'
তার ভাই মদন ও চমন পুরী সফলভাবে চলচ্চিত্র অভিনেতা ছিলেন। তাদের সুপারিশের পরও কোনো পরিচালক অমরীশকে কাজ দেননি। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তিনি বলিউডে কাজ করার স্বপ্ন ছেড়ে দেন। ভাইদের আয়ের ওপর নির্ভর করতে না চেয়ে শেষে তিনি একটি সরকারি বিমা কোম্পানিতে কেরানি হিসেবে যোগ দেন।
বিমা কোম্পানিতে কাজ করার সময়ই অমরীশের পরিচয় হয় প্রখ্যাত নাট্য পরিচালক ও নাটকের শিক্ষক ইব্রাহিম আলকাজির সঙ্গে। আলকাজিই তাকে থিয়েটারে চেষ্টা করে দেখার পরামর্শ দেন।
এর মাঝে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ১৯৫৪ সালে একটি রেডিও স্পট পেয়ে যান অমরীশ। রেডিও নাটক ও হাওয়া মহল প্রোগ্রাম করতে থাকেন তিনি।
আত্মজীবনীতে অমরীশ পুরী লিখেছেন, এর মাধ্যমে রেডিও শ্রোতাদের মধ্যে তার দারুণ জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। তবে অনেক বছর কেটে গেলেও তার অভিনয়ের ইচ্ছা মরে যায়নি।
১৯৬৭ সালে মার্কিন পরিচালক অ্যালানের এমজিএম টিভি সিরিজের তিনটি এপিসোডে অভিনয়ের সুযোগ পান অমরীশ পুরী। এর মাধ্যমেই শুরু হয় চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে তার যাত্রা।
এরপর ১৯৭০ সালে দেব আনন্দের ছবি 'প্রেম পূজারী'তে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে গিরীশ কারনাডের কন্নড় ছবি 'কাদু'তে ভয়ংকর গ্রামপ্রধানের নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এ ছবি মুক্তির পর অমরীশ পুরীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অমরীশ নিজে বলেছেন, 'কাদু' তার জীবন, ক্যারিয়ার ও সামাজিক অবস্থান বদলে দিয়েছে।
অমরীশের অভিনয় দেখে শ্যাম বেনেগাল তাকে 'নিশান্ত'-এ (১৯৭৫) জমিদারের চরিত্রে নেন। এরপর আসে 'মন্থন' (১৯৭৬), 'ভূমিকা' (১৯৭৭) ও 'আক্রোশ'-এ (১৯৮০) অভিনয়ের সুযোগ। তারপর আর অমরীশ পুরীকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
হুম পাঁচ', 'ইম্মান ধরম', 'কুরবানি', 'মিস্টার ইন্ডিয়া', 'শক্তি', 'হিরো', 'মশাল', 'কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি'সহ আরও অনেক ছবিতে প্রধান খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল খ্যাতি কুড়ান তিনি।
ছোট চরিত্রেও এই তারকা দর্শকদের মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। অনেক সময় প্রধান চরিত্রের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলেছেন তিনি। কে ভেবেছিল 'মিস্টার ইন্ডিয়া' ছবিতে অরুণ ভার্মার (অনিল কাপুর) চেয়ে ভিলেন মোগ্যাম্বোকে (অমরীশ) মানুষ বেশি মনে রাখবে?
'মিস্টার ইন্ডিয়ায়' অমরীশ খল চরিত্রে অভিনয় করলেও তার সংলাপই হয়ে ওঠে অবিস্মরণীয়—'মোগ্যাম্বো খুশ হুয়া!'। এছাড়া 'যা সিমরন যা, জী লে আপনি জিন্দেগি' (ডিডিএলজে), 'ইতনে টুকড়ে করুঙ্গা কি তু পহচানা নেহি যায়েগা' (গদর)—পার্শ্বচরিত্রে তার এসব সংলাপ ছাপিয়ে গেছে প্রধান চরিত্রকেও।
এমনকি বিখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গও মুগ ছিলেন অমরীশ পুরীতে। স্পিলবার্গের 'ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য টেম্পল অভ ডুম' সিনেমাতেও প্রধান খলনায়ক মোলারাম চরিত্রে অভিনয় করেন এ তারকা।
হলিউডের এই পরিচালক প্রায়ই অমরীশ পুরীকে বলতেন, 'তুমিই আসল শয়তান!' বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও স্পিলবার্গ একাধিকবার বলেছেন, 'অমরীশ আমার প্রিয় ভিলেন। বিশ্বের সেরা খলনায়ক, যাকে আর কেউ কখনো ছাড়িয়ে যেতে পারবে না।'
অমরীশের অভিনয় দক্ষতা শুধু খল চরিত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। 'ঘাতক'-এ সানি দেওলের সৎবাবা, 'ডিডিএলজে'তে কঠোর ও রক্ষণশীল পিতার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। এমনকি 'চাচি ৪২০'-এ কমেডি চরিত্রেও তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন।
অমরীশের ছেলে রাজীব পুরী বাবার প্রসঙ্গে বলেন, 'তিনি ছিলেন সৎ এবং প্রকৃত কর্মযোগী।' নিজের নীতিতে তিনি ছিলেন অটল। পছন্দসই পারিশ্রমিক না পেলে কোনো সিনেমা ছেড়ে দিতেও পিছপা হতেন না।
একবার রেডিফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একটি ছবি ছেড়ে দেওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে বলেচলিএন, 'আমার প্রাপ্য আমাকে দিতে হবে। আমি তো অভিনয়ে কোনো আপস করি না, তাই না? তাহলে পারিশ্রমিকে কেন কম নেব? মানুষ আমার অভিনয় দেখতে আসে। আমি ছবিতে আছি বলে প্রযোজক ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছেন। তাহলে আমি কি আমার প্রযোজকদের কাছ থেকে টাকা চেয়ে ভুল করছি?'
ক্যারিয়ারজুড়ে অমরীশ পুরী আকণ্ঠ কাজে ডুবে ছিলেন। হিন্দি, পাঞ্জাবি, মালয়ালম, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, ইংরেজিসহ বহু ভাষার চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন।
তবে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাংসারিক মানুষ। কখনও কাজ বাড়িতে টেনে আনতেন না। খাবার টেবিলে সিনেমা নিয়ে কোনো আলোচনাও করতেন না।
অনেক সিনেমায় অমরীশ পুরী প্রেমিক-প্রেমিকার 'শত্রু' হলেও বাস্তবজীবনে স্ত্রী ঊর্মিলা দিবেকারের সঙ্গে তার প্রেমকাহিনি ছিল বলিউডের সিনেমার মতোই। তারা দুজনে বিমা অফিসে চাকেরি করতেন। সেখানে ঊর্মিলা পুরীর সহকারী ছিলেন। দুজনেই ছিলেন লাজুক মানুষ। দুজনের মধ্যে কথা হতো না। উর্মিলার কাছাকাছি যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পুরীর ছয় মাস লেগেছিল।
আত্মজীবনীতে অমরীশ পুরী লিখেছেন, প্রথম দেখাতেই ঊর্মিলার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরিবারের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে তারা বিয়ে করেন।
ক্যারিয়ারে বিভিন্ন ভাষায় ৪০০-র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন অমরীশ পুরী। জানা গেছে, মৃত্যুর সময় তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৬৫ কোটি রুপি), যা তাকে অনেক বলিউড অনেক নায়কের চেয়ে ধনী করে তুলেছিল।
২০০৫ সালের ১২ জানুয়ারি মায়েলোডিসপ্লাস্টিক সিন্ড্রোমে অমরীশ পুরীর মৃত্যু হয়।