ভাষা আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহের জাদুকরী ক্ষমতা ছিল আবুল কালাম আজাদের
'দুঃখজনক হলেও সত্য ভাষা আন্দোলনে এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ নেই। কেউ উল্লেখ করেনি তার নামটি। কিন্তু ইতিহাসের বিচারে কখনো ভুল হয়না। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে চট্টগ্রামের আবুল কালাম আজাদ একটি অবিস্মরনীয় চরিত্র।'- ইতিহাসবিদ ও বাংলা একাডেমির সহকারি পরিচালক আহমেদ মমতাজ এভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন ভাষা সৈনিক আবুল কালাম আজাদ প্রসঙ্গে।
১৯৪৯ সালে বিএ- শ্রেণির ছাত্র আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের জি এস নির্বাচিত হন। তবে এর আগ থেকেই তিনি ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ তমদ্দুন মজলিসের কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিশ যাত্রা শুরু করলে সংগঠনটির মুখপত্র হিসেবে 'সৈনিক' পত্রিকা প্রকাশিত হতো। কলেজ ছাত্র আবুল কালাম আজাদ পত্রিকা প্রকাশের জন্য যাদু প্রদর্শনীর মাধ্যমে তহবিল গঠন করেছিলেন। সে টাকা তিনি তুলে দেন তমদ্দুন মজলিশ সম্পাদক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম সাহেবের হাতে। আবুল কালাম আজাদ ১৯৪৮ সালে তমদ্দুন মজলিশের চট্টগ্রাম জেলা শাখার ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব লাভ করেন।
আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যায়ন কালে বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন সংস্কৃতিক সংগঠন মুকুল ফৌজের সংগঠকও।
অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে চট্টগ্রাম কলেজে ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করেন আবুল কালাম আজাদ। ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর পকিস্তানের শিক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রী ফজলুর রহমান চট্টগ্রাম কলেজ পরিদর্শনে আসলে তমদ্দুন মজলিশের পক্ষ থেকে তাকে একটি খোলা চিঠি (ইশতেহার) দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এই ইশতেহার বিলির অপরাধে ফরমান উল্লাহ খান ও শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাককে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হয়। কিন্তু পুরো পরিকল্পনার পুরোধায় থেকেও কলেজ সংসদের নেতৃত্বে থাকার সুবাদে আবুল কালাম আজাদ সে যাত্রায় রক্ষা পান।
১৯৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ কর্মীরা ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যাদু প্রদর্শনী, কবিগান, মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালার আয়োজন করে।
আবুল কালাম আজাদ ১৯২৫ সালে চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমার তৎকালীন পটিয়া (চন্দনাইশ) থানার উত্তর হাসিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল আজিজ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। মা রশীদা খাতুন। আবুল কালাম ছিলেন পাঁচ ভাই-তিনবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। শৈশবেই বাবার সঙ্গে পার্বত্য জেলার রাঙ্গামাটিতে চলে যান আবুল কালাম। রাঙ্গামাটি গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে তার আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয়। এ বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিদ্যালয় পঞ্চায়েত এর নেতা ও সদস্য ছিলেন আবুল কালাম।
রাঙ্গামাটি জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক স্যার নিবলেট (ব্রিটিশ নাগরিক) তাকে খুব ভালবাসতেন। ইংরেজি ভাষায় আবৃত্তি, বিতর্ক, স্কাউট সদস্য এবং এথলেট হিসেবেও চৌকষ ছিলেন তিনি। রাঙামাটির তৎকালীন ডিসি স্যার নিবলেট তার নামের সঙ্গে 'আজাদ' শব্দটি জুড়ে দেন।
ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর তিনি ডাক্তারি পড়ার লক্ষে তৎকালীন চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন। পরে রাজনীতিতে জড়িয়ে চলে আসেন চট্টগ্রাম কলেজে। কলেজ অঙ্গনের প্রিয়মুখ আবুল কালাম আজাদ মুসলিম হোস্টেলের ম্যাগাজিন ও ডিবেট সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে তমদ্দুন মজলিশ এ যোগ দেন এবং চট্টগ্রাম শাখার ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আবারও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ধারাবাহিক কর্মসূচি হাতে নেয়। কর্মসূচিতে অংশ নিতে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের আহ্বানে ১৯ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিস নেতা আবুল কালাম আজাদ ঢাকায় পৌঁছান। তার ছোট ভাই মোহাম্মদ সোলায়মান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে এক মাসের ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ৯৪, নবাবপুরে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তমদ্দুন মজলিস নেতা আবুল কালাম আজাদ ও তার ভাই মোহাম্মদ সোলায়মানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ভাঙ্গার পক্ষে মত দেন।
৪৩/১, যোগীনগরে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাজের সভায় ১৪৪ ভাঙার ব্যাপারে সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানান দুই ভাই আজাদ ও সোলায়মান। সিদ্ধান্ত হয় পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় সভা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজাদ ও সোলায়মান শিক্ষার্থীদের সাথে আমতলায় সমবেত হন। এসময় তারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সমর্থনে লেখা পোস্টার বিলি করেন। ছাত্র-ছাত্রীরা '১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে', 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'- স্লোগান দিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হয়। এসময় ১৪৪ ধারা ভেঙে শুরু হওয়া মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের লাঠিচার্জে অন্যান্যদের সাথে গুরুতর আহত হন দুই ভাই আজাদ ও সোলায়মান।
এদিকে চট্টগ্রামে গ্রামের বাড়িতে খবর আসে আজাদ ও সোলায়মান আর নেই, তারা আমতলার সমাবেশে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এ খবরে শোকের মাতম নামে পটিয়া (চন্দনাইশ) থানার উত্তর হাসিমপুর গ্রামে। তবে ২৫ ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম আজাদ বাড়ি ফিরেন। তার বেঁচে ফেরার খবরে স্বস্তি ফিরে আসে গ্রামে।
আবুল কালাম আজাদ ১৯৫২ সালে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কাজ করেছেন যুক্তফ্রন্টে।
কর্মজীবনের শুরুতে ঢাকা জিনজিরা আপগ্রেড ইনস্টিটিউটে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, পটিয়া রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশ গাছবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত সাহিত্যিক আহমদ ছফা, সাবেক মন্ত্রী অলি আহমদ বীর বিক্রম প্রমুখ তার ছাত্র ছিলেন। ২০০০ সালের ১১ এপ্রিল এ ভাষাসৈনিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ