এক বাইসাইকেল গেরিলার মিশন
চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের নাম। তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামসহ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পেছনে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী সংগঠন- 'তমদ্দুন মজলিস' এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে বদিউল আলম চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম পাহাড়ে তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক আয়োজিত তিন দিনব্যাপী কেন্দ্রিয় ক্যাম্পে যোগ দেন।
তিনি তমদ্দুন মজলিসের প্রথম পর্যায়ে নিবেদিত প্রাণ এবং পরবর্তীতে তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। বাংলা ভাষার দাবিতে নিয়মিত সভা-সমাবেশ, স্মারকলিপি পেশ ও বিতরণ, তমদ্দুনের মুখপাত্র 'সাপ্তাহিক সৈনিক' ও লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ মিছিল, বিভিন্ন ধরণের পিকেটিং, বইপত্র প্রকাশনা ও বিতরণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
আবুল কাশেম, আবুল মনসুর, কাজী মোতাহের হোসেন চৌধুরী লিখিত 'বাংলা-না উর্দু' পুস্তিকাটি সকল বুদ্ধিজীবী মহলে বিলি করেছেন বদিউল আলম চৌধুরী। ১৯৫১ সালের জানুয়ারিতে লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সভা করেছেন। লিয়াকত আলী খানের 'বেসিক প্রিন্সিপাল' এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে সভা-সমাবেশ করেছেন। বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দরকিল্লা মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি সংলগ্ন মেডিকেল স্কুল ছাত্রাবাস, রথের পুকুর পাড়ে নিয়মিত সভা করেছেন।
তিনি পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাংলা ভাষার দাবিতে গোপন মিশনে নেমেছিলেন। তার এ গোপন মিশনের বাহন ছিল সাইকেল এবং তিনি চট্টগ্রামে 'সাইকেল বাহিনী'র নেতা ছিলেন। 'সাইকেল বাহিনী' গেরিলা যোদ্ধাদের মতো গোপন প্রচার তৎপরতা চালিয়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয় এবং সকল অঞ্চলে বাংলা ভাষা সংগ্রামের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি করে। সাইকেল নিয়ে পুস্তিকা ও লিফলেট বিতরণের সিদ্ধান্ত ছিল প্রথমে বদিউল আলম চৌধুরীর, পরে তমদ্দুন মজলিশ এটিকে সমর্থন জানালেন। 'সাইকেল বাহিনী'র নেতা বদিউল আলম চৌধুরী নিজ পকেটের টাকা দিয়ে ২টি র্যালি সাইকেল কিনে একটি নিজে চালাতেন এবং আরেকটি দিয়েছিলেন তমদ্দুন মজলিশের তারই সহকর্মী মোহাম্মদ হোসেন খানকে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাইকেলে করে তিনি ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুস্তিকা ও লিফলেট পৌঁছে দিতেন। তিনি নিজ এলাকায় নৌকার মাঝিদের এই প্রচার কাজে ব্যবহার করেছিলেন। সাগর দিয়ে নৌকায় করে প্রচারপত্র বিশেষ বিশেষ মাঝিদের হাতে দিয়ে বলতেন সন্দ্বীপ ও সীতাকুন্ড অঞ্চলে পৌঁছে দিতে।
বায়ান্ন'র একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ট্রাজেডির খবর পৌঁছালে সারা বাংলাদেশে দাবানলের মত বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত বীর চট্টলার বদিউল আলম চৌধুরীসহ সকল বীরসেনানিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং সরকার বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঢাকায় ২১শে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ট্র্যাজেডির পর ২২শে ফেব্রুয়ারি মোমিন রোড হতে মিছিল করে লালদীঘি মাঠে সমাবেশ করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন। সে জনসভায় গণপরিষদের সদস্য একে খান-কে পদত্যাগ করে বক্তব্য রাখতে বাধ্য করা হয়। উল্লেখ্য, এ জনসভায় দু'হাজারের অধিক লোক সমাগম হয় এবং সেখানে ব্যাপক গোলযোগ হয় ও একপর্যায়ে সভা ভেঙ্গে যায়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ট্রাজেডির পর চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়, সেই নির্মাণ কাজের সাথে বদিউল আলম চৌধুরী সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।
চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ সরকারের শোচনীয় পরাজয়, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান, একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস ও শহীদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ, বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা মর্যাদা লাভ করা, শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা স্বীকৃতি দেয়া, বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার্থে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা, এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলার তরুণ-যুবকরা গড়ে তোলে বৃহত্তর ঐক্য এবং নবতর উদ্যমে শপথ নেয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। আর এসবের পেছনে মফস্বল শহর এমনকি গ্রাম, পাড়া, মহল্লার তরুণ-যুবকদের মধ্যে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম, একাগ্রতা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে দিবারাত্রি কাজ করেছেন- বদিউল আলম চৌধুরী তাদের একজন।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বদিউল আলম চৌধুরী। চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচনে চট্টগ্রাম অঞ্চলে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পেছনে বদিউল আলম চৌধুরীর অবদান সর্বজনবিদিত।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন বদিউল আলম চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে তার বিবৃতি সমকালীন দৈনিক পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
বদিউল আলম চৌধুরী ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামের বিখ্যাত বনেদি কাট্টলীর নাজির বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর তিনি পরলোক গমন করেন।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ