আমেরিকার গণতন্ত্র কি সুসংহত হবে!
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই পর্দা নামবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন সংক্রান্ত শেষ নাটকটির। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এর উপর নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দিতে নির্ভরশীল হয়ে আছেন। তাদের সঙ্গে আছেন সিনেটর টেড ক্রুজ ও তার ১০ সতীর্থ রিপাবলিকান।
তারা ঘোষণা করেছেন যে, কংগ্রেসের জয়েন্ট সেশনে যে ভোট গণনা হবে তার বিপক্ষে বিদ্রোহ করবেন এবং তারা ভোট গণনার ফলকে স্বীকৃতি দেবেন না। ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স গণনার সময় মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেসের যৌথ সেশনে সভাপতিত্ব করবেন।
এখন প্রশ্ন হলো; তার সাংবিধানিক ক্ষমতা কতটকু? সকল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভোট গণনা কেবলমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আবার এটাও সত্য যে, ভোট গণনার শেষে ফলাফলকে যে সনদপত্র দেওয়া হয়; সেটাই হচ্ছে চূড়ান্ত বিজয়ের স্বীকৃতি।
এখন যদি ভাইস-প্রেসিডেন্ট সেই সনদ দিতে অস্বীকার করেন তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াবে তা খুব স্পষ্ট বলা যায় না। ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলছেন, এখনো অনেক খেল দেখানো নাকি বাকি রেখেছেন। তিনি নিজ সমর্থকদের ওয়াশিংটন ডিসিতে সমবেত হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। এর অর্থ দাঁড়ায়; একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ট্রাম্প সামরিক আইন জারি করার চেষ্টা করতে পারেন।
গত দুইদিন আগে যখন ১৪ জন প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে এক যৌথ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন। সেখানে তারা সশস্ত্র বাহিনীকে সতর্ক করেছেন যে, তারা যেন দেশের সংবিধান বহির্ভূত কোনো পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত না হন। এমন অবস্থায় বিভক্ত রিপাবলিকান দলের কিছু সদস্য যে সনদ দেওয়া বন্ধের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন- সে আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ইতিমধ্যেই, একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে জর্জিয়ার সিনেট পুনঃনির্বাচনে। এতে একজন রিপাবলিকান প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। রিপাবলিকান দলের নেতা এবং অন্য বেশ কয়েক জন সিনেটর ইতিমধ্যেই বাইডেনের বিজয়কে মেনে নিয়েছেন। সুতরাং সেই দিক থেকে হয়তো একথা বলাই যায়, ভাইস প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন সিনেট-কংগ্রেসের যৌথ সভায় যে ভোট গণনা হবে; তা হয়তো শেষ পর্যন্ত ভণ্ডুল করার ষড়যন্ত্র কার্যকর হবে না।
এবারের যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দেশটি যেভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ল সে ঘটনা অতীতে খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। সেকারণে, এর ফলাফল কতটা গভীর হবে তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে বলা যাবে না।
ইতিমধ্যে ট্রাম্পের একটি টেলিফোন বার্তা প্রকাশ হয়েছে। যেখানে তিনি কিছু ভোট তাকে পাইয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন জর্জিয়া রাজ্যের ভোট গণনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। মার্কিন আইন অনুসারে এই ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ট্রাম্পের মেয়াদকালে প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে সমস্ত ঘটনা দ্রুত রচয়িত হচ্ছিলো; তার মধ্যে একটি হলো রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক। প্রকাশ্যে বৈরি ভাব দেখানো, আবার গোপনে গভীর আঁতাত। রুশ এ সমর্থন গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিজয় অর্জনে সহায়তা করেছিল।
আবার চীনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং'কে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বেশি মার্কিন কৃষি পণ্য ক্রয়ের অনুরোধ করেছিলেন ট্রাম্প এবং সেখানে বলেছিলেন, চীন এ সিদ্ধান্ত নিলে আগামী নির্বাচনে আমার জয়লাভ করা সহজ হবে।
ট্রাম্পের কারণেই শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসাবে ছিল, তাদের কাউকে কাউকে ট্রাম্প অবহেলা ও পরিত্যাগ করেছেন। জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা একাই ইরানবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দুটোই ছিল ট্রাম্প মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের একলা চলো নীতির বহিঃপ্রকাশ।
ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেছিল ওবামা প্রশাসন এবং ইউরোপ যৌথভাবে সেই চুক্তিতে সমর্থন দেয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহার করলেও ইউরোপ চুক্তি থেকে সরে যায়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্র গ্রেট-ব্রিটেন সেই চুক্তির অংশ থাকা সত্বেও ট্রাম্প একাই ইরান থেকে চুক্তি বাতিল করেছিলেন। এমনকি বারবার এককভাবে ইরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছিল তার প্রশাসন। এই অর্থনৈতিক অবরোধ প্রকৃতার্থে; বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য থাকার কারণে। ডলারের জোরেই মার্কিন সরকার তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পৃথিবীর উপর চাপিয়ে দিতে পারে, যার উদাহরণ; মার্কিন অবরোধের মুখে দীর্ঘদিন ইরানের আন্তর্জাতিক বাজারে তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। সঙ্গতকারণেই, যুক্তরাষ্ট্রের একচোখা নীতি ইরানি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
আগামীদিন (স্থানীয় সময়) সকালে যখন মার্কিন কংগ্রেসে সেই ভোট গণনা শুরু হবে, ট্রাম্প হয়তো ইরান আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে বসতে পারেন। এরকমটি যদি ঘটে তবে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে এমন বিপজনক অবস্থার সৃষ্টি হবে, যার জের নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বাইডেনকে বহন করতে হবে। সেই সুযোগে যুদ্ধকালীন জরুরি ক্ষমতা জারির চেষ্টা করবেন ট্রাম্প। এটাই তার মূল উদ্দেশ্য।
সুতরাং, আগামী ২৪ ঘণ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নাটকের দৃশ্যপট পরিষ্কার হবে। দেশটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতো রাজনৈতিক অস্থিতিশীল একটি দেশে পরিণত হবে, নাকি তথাকথিত বামপন্থী ডেমোক্রেটরা তাদের সংবিধানের গণতান্ত্রিক ধারা তারা টিকিয়ে রাখবে- সে প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
সকলেই আশাবাদী; ট্রাম্পের রিপাবলিকানরা এমন কিছু করবেন না যাতে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র দুর্বল হয় কিংবা বিশ্বের কাছে তার 'গণতান্ত্রিক' নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষী দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। দেশটি নানান সময়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সুতরাং, মানব সভ্যতার স্বার্থ দেখে কখনোই যুক্তরাষ্ট্র সুস্পষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি।।
খুব কঠিন সময়ে বারবার মার্কিন রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন; ২০০৩ সালে সিআইএ- এর সেই কুখ্যাত রিপোর্টকে কেন্দ্র করে 'ব্যাপক গণবিদ্ধংসী অস্ত্র' থাকার অভিযোগ এনে ইরাক দখল করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক দখলে সমর্থন দেন তৎকালীন ডেমোক্রেট সিনেটর জো বাইডেন এবং হিলারি ক্লিনটন। ডেমোক্রেট পার্টির এ দুই সিনেট সদস্য তখন রিপাবলিকান প্রশাসনকেই সমর্থন দিয়েছিলন। বিশ্ববাসী সেকথাও মনে রেখেছে। অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়; ভিয়েতনাম থেকে কোরিয়া সর্বত্রই একই ইতিহাস রচনা করে যুক্তরাষ্ট্র একটি যুদ্ধবাজ দেশ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
এ যুক্তির নিরিখে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ইরানকে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন- তা খুব বেশি আশ্চর্যজনক কিছু হবে না। কারণ; তিনি জানেন তার দেশের ট্রামবিরোধী লোকজন জো বাইডেনের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক। তারা কেবলমাত্র নিজ দেশের অবস্থান থেকেই সমস্ত কিছু বিবেচনা করছেন । বাইডেন যদি নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তবে হয়তো রাশিয়ার সঙ্গে নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা হতে পারে।
সিরিয়ার মাটিতে আসাদ বিরোধীদেরকে আরো বেশি শক্তি যোগাতে পারে বাইডেন সমর্থন দিয়েছিলেন। ওবামা প্রশাসন সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উচ্ছেদ করার পূর্ব চেষ্টা করেছিল। আসাদ সরকারকে উচ্ছেদ করতে পারলেই কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণ যা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমাদের স্বপ্ন।
তাই, বাইডেনের ক্ষমতায়নে বিশ্ব রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণ হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সিনেটের যে দুটি আসনে জর্জিয়াতে এতদিন রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জানা যাবে সেটা তারা ধরে রাখতে পারলো কিনা।
ভোট গণনার ফলাফলের সর্বশেষ যে হাল দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে ফলাফল ডেমোক্রেট পার্টির অনুকূলে যাবে। আর যদি তাই হয় তাহলে সিনেট এবং কংগ্রেস পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই জো বাইডেন তথা ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পাবে। এই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বিশ্ব রাজনীতিতে একটি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে। আর আখেরে তার পরিণতি কোনদিকে যাবে প্রশ্ন সেখানেই।