ঋতুপর্ণ ঘোষের উপর কলকাতার প্রভাব
একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে, কিংবা একজন ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও, ঋতুপর্ণ ঘোষ যে ঈর্ষণীয় উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, তার পেছনে একটি বিশাল ভূমিকা ছিল কলকাতার। কলকাতার প্রতি এই ঋণ তিনি নিজ মুখেই স্বীকার করতেন। তবে শহর কলকাতার সঙ্গে সমগ্র বাংলার যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে, সেটিও উল্লেখ করতে তিনি ভুলতেন না, এবং এই ব্যবধানকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেও মনে করতেন।
শহর কলকাতার নাম উঠলেই যাদের ছবি সর্বাগ্রে মানসপটে ভেসে ওঠে, তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়। কিন্তু সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, ঋতুর মতে, আরো বেশি কিছু। এটি এমন একটি রাজ্য, যেটি দেশভাগের ফলে প্রভূত ক্ষতির শিকার হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বাংলা ছিল অনেক বেশি প্রগতিশীল। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন মৌলবাদী আন্দোলন মুম্বাই কিংবা ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলকে যেভাবে প্রভাবিত করেছিল, জ্বালিয়েছিল হিংসা ও বিদ্বেষের আগুন, পশ্চিমবঙ্গ সেই আঁচ থেকে অনেকটাই গা বাঁচিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে নিজের বঙ্গবাসী পরিচয় নিয়ে ঋতু ছিলেন গর্বিত।
ঋতুর মতে, কলকাতা যে একসময় ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী ছিল, এই বিষয়টিই বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে শহরটিকে এগিয়ে থাকার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। কলকাতায় জ্ঞানচর্চার কিছু মৌলিক অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল, যেগুলো এখনো বিদ্যমান। এই শহরেই রয়েছে ন্যাশনাল লাইব্রেরি, যেটি ভারতের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি। তারপর রয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি কিংবা এ ধরনের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা, যেগুলো এ অঞ্চলের জ্ঞানান্বেষী বুদ্ধিজীবীদের মগজের পুষ্টি সরবরাহের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আসছে। তাই কোনো বঙ্গসন্তান যদি এমন কোনো কাজে ব্রতী হয়, যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক মনঃসংযোগ অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে কলকাতাই হতে পারে তার তীর্থভূমি।
তবে ঋতু কলকাতার আরেকটি বৈশিষ্ট্যও চিহ্নিত করেছিলেন : এ শহরটির অস্থিমজ্জায় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তির ছাপ লেগে থাকলেও, শহরটি আবার ভীষণ রকমের সাধারণ, সাদামাটা ও আটপৌরে। এটি এমন একটি শহর, যেখানে রোজ বসে বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলা। শহরটি আমলাতান্ত্রিক নয়, অর্থনৈতিকভাবে খুব সমৃদ্ধশালী নয়, বরং অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল। এ শহরের রয়েছে একটি নিজস্ব উষ্ণতা, প্রাণের স্পন্দন। এদিক থেকে নিউইয়র্ক কিংবা লন্ডনের নির্দিষ্ট কিছু এলাকার সঙ্গে কলকাতার সাদৃশ্য খুঁজে পেতেন ঋতু।
শহরের অলি-গলিতে হাজারো মানুষের পদচারণা, তাদের অতুলনীয় প্রাণশক্তিতে টগবগ করতে থাকা, সবকিছুতে পাগলামি, বাড়াবাড়ি কিংবা এক ধরনের হুজুগে মাতাল হয়ে পড়ার প্রবণতা, আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্নাসহ যাবতীয় মানবিক অনুভূতির প্রায় একই ধাঁচের অভিব্যক্তি– এই সবকিছু মিলে কলকাতা যেন এক স্বকীয়, অনন্য রূপ নিয়ে ধরা দিত ঋতুর নয়নে, হৃদয়ে।
কলকাতা নিয়ে ঋতুর দর্শন ছিল এমন: 'বাঙালির যা কিছু আছে, তার সবই আপনি দেখবেন কলকাতায়, তবে কিছুটা পরিশোধিত, ছেঁকে-তোলা গড়নে। আর এ কারণেই শহরটি এতটা চিত্তাকর্ষক।'
ঋতুর বেড়ে ওঠার সময়টায় ভারতবর্ষজুড়ে চলছিল ডানপন্থী রাজনীতির আগ্রাসন। কিন্তু কলকাতাবাসী হওয়ার সুবাদে, তিনি নিজে পেয়েছেন বামপন্থী সংস্কৃতির সান্নিধ্য। ঋতুর চেতনা জাগরণের সময়টা, অর্থাৎ সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে, কলকাতা এক পুরোদস্তুর বাম ঘরানার শহর। অবশ্য তখনো তো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাত্রা ছিল সীমিত। যেমন কলকাতায় যখন টেলিভিশনের আবির্ভাব ঘটেছে, ততদিনে ঋতু স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পথে। ফলে বর্তমান প্রজন্মের চেয়ে ঋতু কিংবা তার সমসাময়িকরা নিজেদের চেতনাকে বিকশিত করার সুযোগ তুলনামূলক কমই পেয়েছেন।
রাজনৈতিক সচেতনতার উন্মেষকাল থেকেই ঋতু দেখে এসেছেন কলকাতায় বামপন্থী শাসনব্যবস্থা। তখন সময়টা এমন ছিল যে বাম রাজনীতি করাই একটি কেতাদুরস্ত ব্যাপার, তা কেউ নিজের ঘটে এই রাজনীতির নানা গলিঘুঁজির ব্যাপারে পর্যাপ্ত বিদ্যা ধারণ করুক বা না করুক!
তবে ঋতু নিজে ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেশাল পেপারের জন্য মার্ক্সটা তিনি খুব মন দিয়েই পড়েছিলেন, আয়ত্ত করেছিলেন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অর্থনীতি নিয়ে পড়া ঋতুর একটি আজীবনের আক্ষেপের জায়গা হয়েও থেকেছে। তিনি মনে করতেন, পেশাগতভাবে অর্থনীতির জ্ঞান তার জন্য কখনোই ফলদায়ক হয়নি; বরং তুলনামূলক সাহিত্য, ইতিহাস কিংবা এ জাতীয় কিছু পড়লেই বুঝি ভালো করতেন।
ঋতুর ছাত্রজীবনে, বাম-প্রভাবের পাশাপাশি বটবৃক্ষের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে কলকাতাকে ছায়াদান করছিলেন আরেকজন মানুষ। তিনি সত্যজিৎ রায়। ঋতু পড়তেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে সপ্তাহের প্রায় প্রতিটি দিনই নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড লেগেই থাকত। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবহ ছিল বিপ্লবঘেঁষা, সংস্কৃতিমনা। এই ক্যাম্পাসে বসেই ঋতু প্রথম দেখেছেন সত্যজিতের ছবি, ঋত্বিক ঘটকের ছবি, হাবিব তানভিরের ছবি। এই ক্যাম্পাসের ছিল নিজস্ব ফিল্ম সোসাইটি, থিয়েটার সোসাইটি। এসবের কল্যাণেই চলচ্চিত্রের প্রতি ঋতুর ভালোবাসাটা আরো গাঢ় হয়েছে।
এখানেই থাকতেই তিনি নিজেও নিয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ। সব মিলিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বছরই, মোটা দাগে, তার পরবর্তী জীবনকে সৃজিত করেছে।
তবে চলচ্চিত্রের প্রতি মোহ সৃষ্টিতে ঋতুর পারিবারিক পরিবেশ-পরিস্থিতির অবদানও কোনো অংশে কম নয়। ঋতুর বাবা-মা দুজনেই ছিলেন মূলত চিত্রশিল্পী। তবে সেই সঙ্গে তার বাবা ছিলেন একজন তথ্যচিত্র নির্মাতাও। অনেকটা শখের বশেই কাজটি করতেন তিনি। তার প্রথম নির্মিত তথ্যচিত্র ছিল এক বিখ্যাত ভাস্করের উপর, যিনি তার সরাসরি শিক্ষকও ছিলেন।
ঋতুর বয়স তখন সবে ১৪। বাবার সঙ্গে শুট করতে যেতেন তিনি। ছবি তোলা হতো হ্যান্ড-ক্র্যাঙ্ক ক্যামেরায়, ১৬ মিলিমিটারে। সম্পাদনার কাজ চলত তাদের খাবার টেবিলে, ফলে খাওয়া-দাওয়া সারতে হতো অন্য কোথাও। শুটিং থেকে শুরু করে শট সাজানো, সবেতেই ঋতু ছিলেন তার বাবার বিশ্বস্ত সহচর। ফলে ওই কিশোর বয়সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে তার সামনে। তিনি জেনে গেছেন: রাশ প্রিন্ট কাকে বলে? কীভাবে সেটি সম্পাদনা করতে হয়? ফাইনাল প্রিন্ট কী? মিক্সিং কখন করতে হয়? সাউন্ডের লেয়ারগুলো কী কী? কীভাবে সেগুলোকে মিক্স করতে হয়? কতগুলো ট্র্যাক সম্ভব? সিঙ্ক-সাউন্ড কী? ফলি সাউন্ড কী? নন-সিঙ্ক সাউন্ড কী?
ঘরে বসেই চলচ্চিত্র নির্মাণের এসব খুঁটিনাটি জেনে যাওয়ায় ১৪ বছরের ওই কিশোরের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই যেন খোলনলচে বদলে গেছে।
চিত্রনাট্য লেখার হাতেখড়িও বাবার কাছেই। প্রায়ই বাবার চিত্রনাট্য লেখায় সাহায্য করতেন ঋতু। আদতে চিত্রনাট্য লেখাটা পরিণত হয়েছিল তাদের ফ্যামিলি অ্যাফেয়ারে। তথ্যচিত্রের নির্মাতা বাবা হলেও, সেখানে যথাসম্ভব ইনপুট থাকত ঋতু ও তার মায়েরও। সবাই মিলে একসাথে চলত চিত্রনাট্যকে ঘিরে সলা-পরামর্শ।
যে ভাস্করকে নিয়ে তথ্যচিত্রটি নির্মিত হচ্ছিল, তাকে বেশ ভালোভাবেই চিনতেন ঋতুর মা। ফলে তার মতামতের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। তবে ঋতুর মতামতকে তার বাবা খুব একটা গ্রাহ্য করতেন না। এমনকি অপত্যস্নেহের বশবর্তী হয়েও না। ঋতুর ভাবনায় কল্পনা ডালপালা মেলত। কিন্তু তার বাবা ছিলেন সেসবের ঘোরবিরোধী। তার সাফ কথা: বাস্তবে যা যা ঘটেছে, সেগুলোই শুধু উঠে আসবে তথ্যচিত্রে। কল্পনার কাছে বাস্তবতাকে বন্ধক রাখা যাবে না।
বাবার সাথে চিন্তাগত এই বৈসাদৃশ্যের কারণেই, তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রতি কখনোই খুব একটা আকর্ষণ অনুভব করেননি ঋতু। তথ্যচিত্রের নিরাবেগ বাস্তবনিষ্ঠতায় তিনি সৃজনশীলতার রস খুঁজে পাননি। তিনি চেয়েছেন গল্পবলিয়ে হতে। এমনভাবে গল্প বলতে, যেন তা ছুঁয়ে যায় সবার হৃদয়। বেরসিকের মতো কেউ যেন জানতে না চায়, 'আচ্ছা, যা বললে সব সত্যি তো?'
বাবার সাথে এই প্রসঙ্গে মতাদর্শের বিরোধ সবসময়ই জিইয়ে রাখতেন ঋতু। তার বাবার দৃষ্টিতে সত্যকে বিকৃত তো করা যাবেই না, সেটিকে নিজের মতো করে ভেবে নেওয়াও চলবে না। কিন্তু ঋতুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সত্যের নিজস্ব ব্যাখ্যা সৃষ্টি এবং সত্যের বিকৃতি এক কথা নয়।
ঋতুর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, গল্পকে বেশিরভাগ সময় তিনি নিজেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন। অন্যের প্রতি ভরসা করে উঠতে পারেননি। সাহিত্যের কিছু অমূল্য নিদর্শনকে তিনি চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেছেন বটে, কিন্তু সেখানেও রেখেছেন নিজস্বতার ছাপ। যেমন 'রেইনকোট'-এর কাহিনি ও'হেনরির 'দ্য গিফট অভ দ্য ম্যাজাই' হতে অনুপ্রাণিত হলেও, মূল নির্যাসটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে তিনি সেখানে বলেছেন প্রায় ভিন্ন একটি গল্প। 'চোখের বালি' রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাসের রূপান্তর হলেও, বদলে দিয়েছেন সেটির সমাপ্তি।
তাছাড়া ঋতু তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রনাট্যও লিখেছেন নিজেই। এক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করেছেন সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণালদের। তিনি বিশ্বাস করতেন, গল্প লেখার সহজাত দক্ষতা রয়েছে তার, এবং অভিনয়যোগ্য সংলাপও অনায়াসে চলে আসে তার কলমে। তিনি বলতেন, 'যখন আমি স্ক্রিপ্ট লিখি, আমি আসলে ছবিটিকে নিজের মাথায় নির্মাণ করি। তাই এটা খুব সহজ হয়ে যায়।'
গল্প লেখা বা চলচ্চিত্র নির্মাণ ঋতুর কাছে সহজাত প্রবৃত্তি ছিল, জোরাজুরির ব্যাপার ছিল না। এ কারণেই তার সিংহভাগ চলচ্চিত্রই বাংলা ভাষায়। কেননা বাংলা ছিল তার মাতৃভাষা। এই ভাষায় চিন্তা করা, চিন্তা করে গল্প লেখাই তার জন্য ছিল সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক। আরেকটি কারণ হলো, মুম্বাই যেমন ভারতের সবচেয়ে কসমোপলিটান শহর, যে কারণে সেখানে এক ধরনের মিশ্র হিন্দি ভাষা বলা হয়, কলকাতা তো তেমন নয়। মুম্বাইয়ে হিন্দি ভাষার শেকড় খুব গভীরে প্রোথিত নয়, যেমনটা কলকাতায় বাংলা ভাষাটা। তাই এখানকার ভাষা হিসেবে বাংলাটাই বেশি চলনসই।
তবে হ্যাঁ, ভাষাকে কখনো নিজের সৃজনশীলতা উপস্থাপনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেননি ঋতু। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, মাতৃভাষায় কাজ করেও আন্তর্জাতিক নির্মাতা হওয়া সম্ভব।
-
[এশিয়া সোসাইটির নারমিন শেখকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে] - লেখক: সাংবাদিক, অনুবাদক