এক প্রকৃতিমানবের জন্য শোকগাথা
আনিস ভাই,
ইস্টার্ন প্লাজার এক রেস্তোরাঁয় আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার কথা মনে পড়ে আপনার? কী নাম ছিল? লা লুনা, বোধহয়।
বাঘ সুরক্ষার একটি সংগঠন গড়ার উদ্দেশে সেখানে একত্রিত হয়েছিলেন কয়েকজন। আমাকে নিমন্ত্রণ জানানোর ভাবনাটি সম্ভবত খসরু চৌধুরীর। এখনো মনে পড়ে, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান বন সংরক্ষক মি. করিমও উপস্থিত ছিলেন। এটি ১৯৯০ কিংবা তারও আগের, সম্ভবত ১৯৮৮ সালের কথা।
তখন আপনি ছিলেন এক তরুণ সংরক্ষণকারী; মাথাভর্তি আইডিয়া আপনার। তবে আপনিও খানিকটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। আপনার সঙ্গে আমার কথা হলো সামান্যই; তারপর বন্ধুত্বের শুরু।
একপাক্ষিক বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিল সেটি। ভালোবাসা ও জ্ঞান দিতেন আপনি; আর আমি ছিলাম গ্রহিতা। হুট করেই সন্ধ্যাবেলা দ্য ডেইলি স্টারে হাজির হতেন আপনি; আমার পাশে বসতেন, তারপর সিগারেট ধরাতেন আর বলতেন, 'ইনাম ভাই, চলেন। দারুণ একটা জায়গায় যাব।'
পতঙ্গ যেমন আলোর দিকে ধায়, আমিও তেমনি আপনার পিছু নিতাম। পরের দিন আমাদের দুজনের ঘুম ভাঙত এমন অদ্ভুত কোথাও, যে এলাকার নাম আমি শুনিনি আগে কোনোদিনই।
কতগুলো রাত আমরা নদীর তীরে বসে কাটিয়েছি, আপনার মুখে জলপ্রণালীর বর্ণনা শুনে, জোয়ার-ভাটা দেখে, আর নদীতীরে মাছ ধরতে থাকা জেলেদের বকবকানিতে? তারপর আপনি চুপ হয়ে স্রেফ তাকিয়ে থাকতেন তারার দিকে, আর একের পর এক ফুঁকতেন সিগারেট।
চরে কাটানো সেই তপ্ত দুপুরের কথা মনে পড়ে আপনার? আমরা অবিরাম হাঁটছিলাম আর আপনি বালিয়াড়িতে জমে থাকা পানির দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে পতঙ্গ ও ব্যাঙ করছিলেন পর্যবেক্ষণ। হুট করেই দুপুরের আলো বদলে গিয়ে হয়ে ওঠল কালো; না, কালো নয়, বরং গাঢ় নীলচে মেঘের দেখা মিলল দিগন্তে। নিজেদের সামনে অন্তত কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে সেই আজব সাদা দেয়ালের দেখা পেলাম আমরা।
আপনি বললেন, 'দৌড়ান।' আমরা ছুটলাম।
চরের মাঝখানে প্রচণ্ড ধূলিঝড়ের মাঝখানে পড়ে গেলাম আমরা। একে অন্যকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমনকি নিজেদের হাতও পাচ্ছিলাম না দেখতে। সেই মুহূর্তে আমাদের যেন কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আমরা হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছিলাম; চোখের সামনে একটা সাদা কুয়াশার জাল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ঝড়ের ভয়াবহ শব্দ ভেসে আসছিল কানে; আর আমাদের খোলা পিঠে আঘাত হানছিল যন্ত্রণাদায়ক বালুরাশি। ভেবেছিলাম, এ যাত্রায় প্রাণে বাঁচব না।
তবে মিনিট ১৫ পর ঝড় থেমে গেল, আর আমরা শরীরভর্তি বালু নিয়ে সেখানে তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে।
সেদিন পরে আপনি আর আমি নদীটির তীরে বসে দূরাগত আলো দেখছিলাম। সেই ভয়ানক ঝড় তখন স্রেফ একটি দূরের স্মৃতি।
প্রিয় আনিস ভাই,
অরণ্যে আমাদের হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে আপনার? নিশ্চুপভাবে। তারপর সেই নীরবতা ভেঙে আপনি আমাকে এক ধরনের পাখি কিংবা সেটির বাসা দেখালেন। একদিন একটা সাপ ধরেছিলেন, আর সেটির বিষদাঁত দেখিয়েছিলেন আমাকে। পুরনো অ্যালবামে এখনো আমার কাছে সেই ছবি রয়েছে: সাপের মাথা ধরে রেখেছেন আপনি।
এক সকালে এসে বললেন, 'চলুন, শেরপুর যাই। কেউ একটা বনরুই ধরেছে।' আমরা একটা মাইক্রোবাসে চেপে বসতাম; আর সেই বনরুইকে আবিষ্কার করলাম গাছে বাঁধা অবস্থায়। আপনি গারো লোকটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন; তারপর ওই বন্দিকারী রাজি হলো বনরুইটি ছেড়ে দিতে। আমরা ওকে নালিতাবাড়ি বনে এনে ছেড়ে দিলাম। প্রাণীটা বাঁচবে কি না, সন্দেহ ছিল আমার; আপনার ছিল না।
একদিন আমরা কয়েকটা মেছোবাঘের শাবক পেলাম। খুবই পুঁচকে। রাতে আপনাকে ফোন করলাম আমি। আপনি তখন দুবাইয়ে থাকেন, দুবাই মিউনিসিপালিটিতে কাজ করেন। বললেন, শাবকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা দুরূহ হবে; কারণ, ওগুলোর জন্য বিশেষ দুধ প্রয়োজন।
আনিস ভাই,
মনে পড়ে এক শীতে আমরা চান্দার বিল থেকে ফেরার সময় এক লোককে দেখেছিলাম মেষশাবকগুলোকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে? ওই মেষপালে মিষ্টি দুটি শাবক ছিল; আমাদের খুব মনে ধরেছিল। আমরা ওই দুটি শাবক ৫০০ টাকায় কিনে নিয়েছিলাম। টাকা দিয়েছিলেন আপনি।
আমরা ওগুলোকে বাড়িতে পুষেছি। কার বাড়ির মেষশাবকটি কেমন আছে, স্রেফ তা জানতে আমরা একে অন্যকে ফোন করতাম।
আপনার মনে পড়ে, আমরা একবার ছোট বাবুইবাটান পাখির বাসা খুঁজতে পদ্মার চরে গিয়েছিলাম; পেয়েছিলামও? আরেক হিমশীতল শীতের সন্ধ্যায় কুয়াশায় ঘেরা নদী পেরিয়ে আমরা আরেকটি চরে গিয়েছিলাম। সেখানে হাঁটা নিরাপদ ছিল না মোটেও; অথচ আপনি তখন গভীর আলাপ জুড়ে দিয়েছিলেন, আর আমাকে দেখাচ্ছিলেন- কী করে মাটির গঠন হয়, কী করে লাখ লাখ বছর ধরে হিমালয় থেকে ভেসে আসা বালুকণায় গড়ে উঠেছে ভূমি আর তাতে জড়ো হয়েছে পতঙ্গ, আর পাখির বিষ্ঠার সঙ্গে মিলেমিশে জন্মাচ্ছে জীবাণু। আপনি হাঁটু গেঁড়ে বসে, মাটি তুলে আমাকে সেই বিস্ময়কর ঘটনা দেখিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন এক পরিযায়ী পাখির কথা, আর শুনিয়েছিলেন এর সঙ্গে প্রসঙ্গিক গল্প: কী করে এই পাখি হিমশীতল উত্তর মেরু থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এ দেশে আসে গ্রীষ্মকাল কাটাবে বলে।
আরেকদিন, যখন আমরা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম, আপনি হঠাৎ রোমাঞ্চিত হয়ে আমাকে ডাকলেন আর একটা উদ্ভিদ দেখালেন; ওই উদ্ভিদের নাম ভুলে গেছি বলে ক্ষমা করবেন। একেবারেই অনুপম উদ্ভিদ ছিল সেটি। এর ছিল পাঁচটি ভিন্ন ধরনের পাতা কিংবা পাঁচটি ভিন্ন আকার। এ ধরনের কোনো উদ্ভিদ আমি আর কখনোই দেখিনি।
আনিস ভাই,
আমার পোষা কুকুর পাপির কথা মনে পড়ে আপনার? আপনি ওর ভক্ত ছিলেন। ফিল্ড ট্রিপের সময় আমরা ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। একদিন হাঁস ধরার উদ্দেশে ওই বোকা কুকুর বিলের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর ভিজে-টিজে পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা পাখির বাসার ওপর জরিপ চালাচ্ছিলাম। রাতের বেলা ওই পুঁচকে কুকুরের নাকের ভেতর আপনি একটা জোঁক আবিষ্কার করেছিলেন।
পাপির মর্মান্তিক মৃত্যু আপনাকে কতটা ব্যথিত করেছিল, এখনো আমার মনে পড়ে। আমার সবচেয়ে আদরের পোষা প্রাণীটির প্রতি আপনার গভীর অনুভূতির জন্য ধন্যবাদ জানবেন।
প্রিয় আনিস ভাই,
পদ্মায় ডলফিনের অভয়ারণ্য তৈরির জন্য আপনি যখন কাজ করছিলেন, সহসাই আমাকেও জানিয়েছিলেন নিমন্ত্রণ। কিন্তু আমি যেতে পারিনি। সে কারণে ভীষণ দুঃখ প্রকাশ করছি। কিন্তু একদিন আপনার উদ্দেশে ঠিকই বেরিয়ে পড়েছিলাম; তবে শাহজাহান সরদার ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে থেমে গেলাম, সেখানে আম গাছের নিচে সারা রাত বসে কাটিয়েছিলাম আমরা। রাতভরই থেমে থেমে টুপটাপ ঝরে পড়ছিল আম।
সে রাতে প্রকৃতি সুরক্ষায় আপনার প্রচেষ্টাগুলোর স্মৃতিচারণ করেছিলাম আমি: ন্যাচার কনজারভেশন মুভমেন্ট (ন্যাকম) নামে যে সংগঠন আপনি গড়ে তুলেছিলেন, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব কাজ আমরা দেখেছি।
মরামারি যখন এলো, আপনাকে নিয়ে উৎকণ্ঠা হচ্ছিল আমার। এখনো নিজ উন্মাদনার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন কি না, জানতে চেয়ে ফোন করেছিলাম। চিরচেনা নির্বিকার ভঙ্গিমায় আপনি বলেছিলেন, করোনাভাইরাস আপনাকে সহসা ছুঁতে পারবে না। তার মানে, আগের মতোই অক্লান্ত দৌড়ঝাঁপ চলছিল আপনার।
অবাক ব্যাপার, গত কয়েক সপ্তাহে আপনার কথা আমার ক্ষণে-ক্ষণে মনে পড়েছে; আর আপনাকে মিস করার এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেছি আমি। আপনাকে ফোন করতে চেয়েছিলাম। ভাবছিলাম সেই আজব উদ্ভিদের কথা; আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম, ওর সেই অবাক করা পাতাগুলোর কাছে আপনি যেন আমাকে আরেকবার নিয়ে যান।
কোভিড আপনাকে ছুঁতে পারেনি, কিন্তু পেরেছে অন্যকিছু। আপনার বেপরোয়া জীবনযাপনের কারণেই সেটি এগিয়ে আসছিল। কিন্তু আপনার অন্তত জানা উচিত, যখন পৃথিবীকে চিরতরে বিদায় জানাতে শেষবারের মতো চোখ বুজলেন, তখনো একজন ফিল্ড বায়োলজিস্ট হিসেবে নিজের যে কাজ সবচেয়ে প্রিয়- সেই গবেষণা ও জরিপের মধ্যেই আপনি ছিলেন বলে আমি আনন্দিত।
- লেখক: সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: A requiem for the nature's man
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
-
আরও পড়ুন: পরিবেশ বিজ্ঞানী আনিসুজ্জামান খানের প্রয়াণ