করোনাকালে বাংলাদেশে দুর্নীতির সক্ষমতা ও অভিনবত্ব বেড়েছে
ক'দিন আগে আমার এক ছোট ভাইয়ের ল্যাপটপের আজব রোগ ধরা পড়ল। অন করলেই ক্রমাগত 'পি' প্রেস হতে থাকে। পাসওয়ার্ড লিখতে গেলে লেখা উঠতে থাকে পিপিপিপি। নানা ফন্দি-ফিকির করেও এই 'পি' ওঠার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিলনা। ভাইটি গুগল করে সমাধান খুঁজে, ইউটিউবে ডজন ডজন ভিডিও দেখে। কনফিগারেশন নানা অদল-বদল করেও কিছু করতে পারলো না। ওর মনে হল কখনো কখনো কঠিন সমস্যার সমাধান খুব সহজ জায়গায় লুকিয়ে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করলো ওর কীবোর্ডটাতে কোনোভাবে পি-তে চাপ পড়ে ছিল। ল্যাপটপ সেই কমান্ড অনুযায়ী 'পি' চেপেই যাচ্ছিল। কাজেই সেই বাটনটা ঠিক করার পরই সব সমস্যার সমাধান হলো।
এই ঘটনা থেকে আমরা কী শিখলাম? শিখলাম যে সাহেদ-শারমিনরা যতই ধরা পড়ুক না কেন, মূল সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। সেখানে হাত দিতে না পারলে পি চাপা কখনোই বন্ধ হবে না। আর ক্রমাগত পিপিপি লেখা হতেই থাকবে। ঠিক যে কারণে বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র নিরসন করে, প্রবৃদ্ধি ও জিডিপি বাড়িয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেলেও দুর্নীতি ঠেকাতে পারছেনা। অথচ বাংলাদেশের মূল সমস্যা এই দুর্নীতি।
বাংলাদেশে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করেন যে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? সবাই বলবেন দুর্নীতি। দেশে দুর্নীতি যেমন বাড়ছে, তেমনি এর ধরণেও যোগ হয়েছে অভিনবত্ব। লোকে ব্যঙ্গ করে বলে বাংলাদেশে ঘুষ-দুর্নীতির সক্ষমতা বেড়েছে। কারণ বিভিন্ন সেক্টরে কোটি টাকার ঘুষ অফার করা হচ্ছে, শত কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে, তোষকের নীচ, সিন্দুক, স্যুটকেস কিংবা গাড়ির ভেতর থেকে হাজার কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে। অন্যদিকে হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে যাচ্ছে। এই লেনদেনের বিশাল অংক দেখে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন পেশার লোকদের অবৈধ আয়ের পরিমাণ নিয়ে।
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথমসারিতে ছিল, আছে, থাকবে। পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, পণ্য প্রস্তুতকারক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, বেসরকারি পেশাজীবিদের একটা অংশ দুর্নীতিপরায়ণ। অনেকে বলেন বাংলাদেশীরা খাওয়ার ক্ষেত্রে হালাল-হারাম মেনে চলেন, কিন্তু আয়ের বেলায় নয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ের কোন হিসাব নেই, হয়না কোন অডিট। অডিট ছাড়া কোন আয় বৈধ হয়না। এখানে টাকা কোন দায়বদ্ধতা ছাড়াই ব্যয় করা হয়।
ধারণা করা হয়েছিল বেতন কম পান বলেই সরকারি সেক্টরে এত দুর্নীতি। ২০১৫ সালে দেয়া জাতীয় মজুরি কাঠামোতে বেতন ভাতা বেড়েছে প্রায় ১০০ গুণ। সবকিছু মিলিয়ে এখন জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশই বরাদ্দ করতে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বেতন ভাতার পিছনে। কারণ একটাই যাতে সরকারি কাজে দুর্নীতি কমে। কিন্তু তা কমেনি। এই করোনাকালে এসে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা হিসেবে যে টাকা দেশের দরিদ্র মানুষকে দিতে বলেছিলেন তা সুষ্ঠু মতো দেয়া হয়নি। দরিদ্রদের ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার প্রোগ্রাম চালুর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে। মহামারি পরিস্থিতিতে সরকারি দপ্তরগুলো ঠিকমতো কাজ করছেনা বলেই এই উদ্যোগগুলো সফল হচ্ছেনা।
সবচেয়ে দু:খজনক ও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে পয়সাকড়ি লোপাট হচ্ছে, বিভিন্নজনের নামে অভিযোগ আসছে, কেউ কেউ গ্রেফতারও হচ্ছে, গণমাধ্যমে নিউজ হচ্ছে, আমরা হৈচৈ করছি কিন্তু মূল ফলাফল কী? আমার এক বন্ধু তার স্ট্যাটাসে লিখেছে "বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি করে যারা পাপ কামায় তাদের কষ্ট করে আর তীর্থস্থানে যেতে হয় না। পদত্যাগ, বদলি, ওএসডি বা সাময়িক বরখাস্তের মতো নানা কঠিন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার পর তারা আবার শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।" আমি যোগ করতে চাই, শুধু সরকারি চাকরি নয়, সব অপরাধীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য। আর সেইকারণেই রুই কাতলা অপরাধীরা ধরা পড়ার পর হাজতখানায় না থেকে হাসপাতালে থাকে বা ব্যাংককে চলে যায়।
২০১৭ সালে করা টিআইবি'র একটি জরিপে বলা হয়েছে সেবা সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ঘটে থাকে। শতকরা ৬৬ ভাগ উত্তরদাতা একথাই বলেছেন। শতকরা ৮৯ জন ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ এছাড়া কোন কাজ হাসিল হয়না। এছাড়া দেশে রাজনীতি ও ব্যবসার সম্পর্ক খুব জোরাল। রাজনীতিবিদ, এমপি ও মন্ত্রীদের অনেকে ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন ও আছেন। তারা মনে করেন না যে ক্ষমতায় থেকে ব্যবসা করাটা উচিৎ নয়। অথচ এই কারণেই ব্যক্তিগত লাভের জন্য বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্প পাশ হয়ে যায়।
২০০৭-২০০৮ সালের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের তৎপরতা দেখে সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠেছিল। ভেবেছিল আর বোধহয় এদেশের মানুষ দুর্নীতি করার সাহস পাবেনা। কিন্তু না, দুর্নীতি থেমে থাকেনি। এর ধরণ ধারণে আরো অভিনবত্ব এসেছে।
করোনা মহামারি এসে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দুর্নীতি কতধরণের হতে পারে। করোনার সার্টিফিকেট দেয় যে হাসপাতাল, সেই হাসপাতালের জালিয়াতির পর প্রকাশ পায়, হাসপাতালটির লাইসেন্সই ছিল না ছয় বছর ধরে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ। আর লাইসেন্সই নেই শতকরা ১০ শতাংশের। লাইসেন্স ছাড়াই এসব হাসপাতাল ক্লিনিক বাণিজ্য করছে বছরের পর বছর। রিজেন্টের সাহেদ আর ও সাবরিনার জালিয়াতি নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশের খবর ছাপা হয়েছে। দেশে মহামারিতে মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, সেই মহামারির প্রতিটি প্রয়োজনীয় প্রডাক্ট নিয়ে জালিয়াতি চলছে।
রিজেন্টের সাহেদ একজন টকশো বোদ্ধা, ডা. সাবরিনা একজন কার্ডিয়াক সার্জন, দেড় হাজার কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পালানো পি কে হালদার বুয়েট থেকে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার, রূপপুর বালিশ প্রকল্পের প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের চারজনই হলেন চিকিৎসক। জুম মিটিংয়ের অস্বাভাবিক খরচ দেখানো, আর রুপার দামে বটি কিনতে যাওয়া মানুষগুলো সবাই প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ( সূত্র: আসিফ ইমতিয়াজ, প্রথম আলো)। তাহলে আমরা কার থেকে কী ভাল কাজ প্রত্যাশা করবো?
আমাদের বিবেক এখন এমন পর্যায়ে যে মানুষের মৃত্যু নিয়েও দুই নাম্বারি করতে আমাদের হাত কাঁপেনা। করোনার মতো মহামারিকে কেন্দ্র করে অমানবিক কাজের মাত্রাও বাড়ছে। খাবার, ওষুধ, মাস্ক থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, রিজেন্ট, জেকেজি, পর্দা, বালিশ, রানা প্লাজা, ভবনধস, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন, ফাঁসির আসামীর ক্ষমা পাওয়া, বাঁশ দিয়ে ঘর বা সেতু নির্মাণ দেখে দেখে আমরা তব্দা লেগে যাচ্ছি। করোনা হয়তো একদিন সেরে যাবে কিন্তু আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় থামবে কি?
দুর্নীতিতে একটার পর একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। সবাইকে চমকে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে সিকদার গ্রুপের দুই ভাই। করোনার মধ্যে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চার্টার্ড বিমানে করে দেশ থেকে পালিয়েছিল এই দুই ভাই। তাই তারা আত্মসমর্পণটাও করেছে একটু আলাদা স্টাইলে। থাইল্যান্ডে বসেই তারা সারেন্ডার করেছে ভার্চুয়ালি। ভিডিও কলের মাধ্যমে এরকম ভার্চুয়াল আত্মসমর্পণ এর আগে দেখেনি বাংলাদেশ। হয়তো তারা ভবিষ্যতে এও বলবে যে তারা অনলাইনেই জেল খাটতে চায়।
করোনাকালে অনেক দেশই দুর্নীতি নিয়ে কমবেশি সংকটে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্নীতির ক্ষেত্রে যে বৈচিত্র্য, তার ধারেকাছেও কেউ নেই। সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ভুয়া করোনা টেষ্টের কেলেঙ্কারি। এই দেশে বিদেশে আমরা অসম্মানিত হচ্ছি। কিন্তু এরপরও কারো গায়ে কোন আঁচড়ও লাগছে না।
করোনাকালের দুর্নীতির বড় অংশজুড়ে আছে কেনাকাটার চুক্তি ও পণ্যের অতিমূল্যায়ন। কেনাকাটায় প্রকিওরমেন্ট পলিসি মানা হচ্ছেনা, স্বচ্ছতা থাকছেনা, জবাবদিহিতাও থাকছেনা। সুতরাং মহামারির এই সময়ে বাংলাদেশেও দুর্নীতি হবে, সেটা সবাই জানলেও ঠিক এইভাবে হবে, এটাও কেউ ভাবেনি। মহামারি ঠেকানোর জন্য ভবিষ্যতে অনেক বিদেশী সাহায্য আসবে, সরকার অনেক টাকা এই খাতে খরচ করবে, সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমণ করা না গেলেতো মহা বিপদ হবে।
আমরা সবসময় স্বপ্ন দেখি যে বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশগুলোর মতো হবে। কিন্তু কীভাবে? গড় আয়ু, শিক্ষা, জনপ্রতি খাদ্য গ্রহণের, মানব উন্নয়নের হার বাড়ালেই হবেনা। দমন করতে হবে দুর্নীতি, বাড়াতে হবে সর্বস্তরের জবাবদিহিতা। কিন্তু সেটা কি সম্ভব হবে? কানাডার মতো দেশেও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকেও অর্থনীতি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেশের ৩৫ হাজার স্কুল ছাত্রকে সরকারি অনুদানের অর্থ বিতরনের জন্য 'উই চ্যারিটি' নামে একটি বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ দেয়া নিয়ে তৈরি হ্ওয়া বিতর্কে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে হয়েছে তাকে।
ট্রুডোর বিরুদ্ধে 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট' এর অভিযোগে এথিকস কমিশনও আলাদা তদন্ত করছে। ট্রুডোর স্ত্রী চ্যারিটি সংস্থার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, ট্রুডোর মা এবং ভাই পেশাদার বক্তা হিসেবে এই সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন সম্মানির বিনিময়ে। ট্রুডোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তার পরিবারের সদস্যরা যে প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পারিশ্রমিক নিয়েছেন, সেই প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত থাকাটা ঠিক হয়নি। মানে ক্যাবিনেট মিটিং-এ প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিত থাকা উচিৎ ছিলো। সেটা তিনি করেননি বলেই তাকে এখনি আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো।
সেই ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সবাই ঘরে ঘরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দূর্গ করে তুলুন। দুর্নীতি আর বরদাশত করা হবেনা। বাংলার মাটিতে দুর্নীতির কোন স্থান নেই। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। আমি আইন প্রয়োগ করবো। কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই কাজ করার আগেই বঙ্গবন্ধুকে পরিবারশুদ্ধ হত্যা করা হয়। কী জানি, হয়তো সেই দুর্নীতিবাজদেরই কাজ ছিল এই হত্যাকাণ্ড। এরপর থেকে আজ অব্দি চলছেই। দিনে দিনে দুর্নীতির ক্ষেত্র, প্রকোপ, আয়োজন ও অভিনবত্ব বাড়ছেই।
দুর্নীতির চক্রটা খুব শক্তিশালী। একে ঠেকাতে না পারলে বাংলাদেশ কোনদিন তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবেনা। বিশ্বের অনেক দেশে দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য চালু করেছে ই-প্রকিওরমেন্ট পলিসি, ফিন্যানসিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট, পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার। আমাদেরও এসব চালু করতে হবে। সৎ মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দুষ্টের দমন করতে না পারলে, এই কীটরাই একদিন দৈত্য হয়ে পুরো দেশকে গিলে খাবে। এত এত অর্জন, তখন কোন কাজেই লাগবেনা।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
৪ আগষ্ট, ২০২০