গান্ধী থাকলে কী করতেন?
দুনিয়ায় এখন চলছে বহুস্তরী সংকট। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা ও জলবায়ু সংকট- সব একাকার হয়ে গেছে রাজনৈতিক ও নৈতিক নেতৃত্বের অভাবে। এমন সংকটের সামনে পড়লে কী করতেন মহাত্মা গান্ধী?
এই ভাবনা থেকে একটি ৯ দফা নিরীক্ষাধর্মী কর্মযজ্ঞের কথা ভাবা যাক।
প্রথমত, এই ভাইরাসের চেয়েও অনেক বেশি মারাত্মক হলো বৈশ্বিক মহামারির আতঙ্ক, যা পৃথিবীকে বিকলাঙ্গ করে দিয়েছে। গান্ধী বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের বলতেন, শুরুতেই যেন ভয় ঝেড়ে ফেলি; যেমন করে ঝেড়ে ফেলতে বলেছিলেন তিনি ব্রিটিশ-ভীতি।
দ্বিতীয়ত, অসুস্থের সেবাদান ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি। কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের শারীরিক শুশ্রূষা ও সেবা দরকার। গান্ধী নিশ্চয়ই তাদের সেবা করতেন। স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে নিশ্চয়ই খুঁতখুঁতে হতেন তিনি। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, নিজের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতায়ন, এবং কমিউনিটিতে যত্ন পাওয়ার ব্যবস্থার ওপর গান্ধীর জোর দেওয়াটা নিশ্চয়ই নিখুঁত হতো।
তৃতীয়ত, 'নিজের দেখা সবচেয়ে অসহায় ও হতভাগ্য মানুষের প্রতি' আমাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে, সেটি পালনের পথ নির্দেশনায় গান্ধী হয়তো তার বিখ্যাত কবচ দিতেন। বাস্তুচ্যূত শহুরে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ক্ষুধা ও অপমানের গ্লানি থেকে নিঃসন্দেহে তার সেই কবচে রক্ষা পেত। গান্ধী তাদের কাছে ছুটে যেতেন। তাদের মর্যাদা ও আশা বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করতেন; এবং সরকারের উদাসিনতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিরুদ্ধে ঐক্য ও প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে পা বাড়াতেন। সেটিকে হয়তো 'নয়া ড্যান্ডি মার্চ' বলা হতো।
চতুর্থত, সামাজিক একতাবদ্ধতা ছিল গান্ধীর জীবনের শেষ অথচ অসম্পন্ন কার্য। ভাইরাসটির আবির্ভাব যখন ঘটল, তখন কিছু নেতা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোয় ছিলেন ব্যস্ত। গান্ধী বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই সামাজিক বিভাজন দূর করাকেই অগ্রাধিকার দিতেন, সে কাজে অঘোরে তার প্রাণ হারানোর শঙ্কা থাকলেও। সব ধর্মের, সব গোত্রের মানুষকে একত্রিত করে, তাদের একেকজনকে অন্যের এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে পাঠানোর চেষ্টা হয়তো করতেন তিনি।
পঞ্চমত, সংক্রমণের ভয় এবং কঠোর লকডাউন মানুষকে বাধ্য করেছে নিজের ঘরে খিল এঁটে সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে। গান্ধী নিশ্চয় প্রশ্ন তুলতেন- যোগাযোগ ছাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ও কমিউনিটি গড়ে উঠবে কীভাবে? আমার ধারণা, লকডাউনের সৃষ্টি করা 'মহল্লা'কে চ্যালেঞ্জ করে সত্যাগ্রহের ব্যাপ্তি আরেকটু বাড়িয়ে তুলতেন গান্ধী। যোগাযোগ নিষেধের সেই পর্দাটি আচমকাই সরিয়ে দেওয়ার পর যে কেউ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, এই বৈশ্বিক মহামারি ও আতঙ্ক আমাদের মনে কী গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ গেঁথে দিয়ে গেছে। আমাদের সবাইকে 'এক অস্পৃশ্য' সত্তায় পরিণত করেছে এটি।
ষষ্ঠত, কোভিড-১৯-এর মুখোমুখি হয়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় নেতৃত্ব সাঙ্ঘাতিক তালগোল পাকিয়েছে, এবং লক্ষ্যবস্তু পাল্টে ফেলেছে। কোনো ব্যাপারে কম জানাশোনা নিয়ে সেটির বিচার করতে গেলে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক; তবে ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়া মতো সৎ সাহস কই? গান্ধী হলে নিজ ভুল স্বীকার করে নিতেন। আর বিস্ময়করভাবে, সেই ঘটনা তার প্রতি লোকের আস্থা আরও বাড়িয়ে তুলত।
সপ্তমত, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট কিংবা একটি নতুন ভাইরাসের আবির্ভাবের মতো দূরবর্তী কম্পনের মুখোমুখি হয়ে, এক যুগ ধরে আমরা একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভাঙনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। গান্ধী নিশ্চয়ই আমাদের স্থানীয় উৎপাদন ও স্থানীয় ব্যয়ের (গ্রাম স্বরাজ) স্থিতির কথা মনে করিয়ে দিতেন।
অষ্টমত, ভোক্তারা হয়তো জিজ্ঞেস করবে, 'আমাদের প্রয়োজনগুলোর কী হবে?' গান্ধী নিশ্চয় ব্যাখ্যা দিতেন, ভোগের এই অশেষ আকাঙ্ক্ষা আসলে কোনো প্রয়োজনীয়তা নয়। নিজেদের লালসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আধুনিক সমাজের অনেক বাহুল্য উপাদান ছাড়াই আমাদের পক্ষে হাসিখুশি জীবন কাটানো সম্ভব।
নবমত, শেষ পরামর্শ হিসেবে আমাদের আরাধনা করতে নিশ্চয়ই বলতেন গান্ধী। প্রতিটি দিনের শেষে, চুপচাপ বসে, নিজেকে স্রষ্টার কাছে, জীবনের কাছে, সত্যের কাছে, ইতিহাসের কাছে সমর্পণ করতে বলতেন। নিজের পক্ষে যা করার, করেছেন আপনি। এখন পিঠে বোঝা বয়ে বেড়ানোর মানে হয় না। এই অশেষ ব্রহ্মাণ্ডে নিজের প্রচেষ্টাকে উপলব্ধি করুন। নিজেকে সমর্পণ করুন আর বলুন: 'সব ঠিক হয়ে যাবে।' 'ইনশাল্লাহ'। 'হে রাম।'
গান্ধীর জন্য অপেক্ষায় থাকার দরকার নেই আমাদের। তিনি থাকলে আমাদের জন্য যা করতে পারতেন, নিজেদেরই তা করা উচিত।
- লেখক: 'পদ্মশ্রী'জয়ী ভারতীয় সমাজকর্মী
হিন্দুস্তান টাইমস থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ