চারের ফেরে বে-চারা চড়ুই: বিংশ শতাব্দীতে পরিকল্পিত নির্মম পাখি গণহত্যার করুণ গাথা
বর্তমান পৃথিবীতে একটি মহান দেশ আছে, যা অচিরাৎ অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে ভূমণ্ডলের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। হ্যাঁ পাঠক, ধরতে অসুবিধা নেই, দেশটি গণচীন। তো, মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে বিপ্লবের পর দেশটি চারের ফের থেকে কেন যেন বের হতেই পারছে না। তার মধ্যে সবচেয়ে বীভৎস, ভয়ঙ্কর, প্রথম চারের ফেরটি। বাকিগুলো সম্পর্কে একটু বলে নিই, প্রথমটা খোলাসা করার আগে।
দ্বিতীয় চারের ফেরটি গণচীনে ১৯৬৬-৬৯ 'মহান' (?) সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ের। মাও সে তুং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরুতেই ডাক দিলেন 'The Destruction of Four Olds'-এর। 'চারটি পুরাতনের ধ্বংসে'র আহ্বান।
কী কী?
পুরাতন প্রথা (Old Customs), পুরাতন সংস্কৃতি (Old Culture), পুরাতন অভ্যাস (Old Habits), পুরাতন ধ্যানধারণা (Old Ideas)। রেড গার্ডসরা নেমে পড়ল মহান কাজে। সাংস্কৃতিক নিদর্শন (Cultural artifacts), চৈনিক সাহিত্য, পেইন্টিং, ধর্মীয় প্রতীক ও মন্দির ধ্বংস ও বহুর বহ্ন্যুৎসব হলো। তার সঙ্গে এসবের মালিকদের ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্যাতন ও নিগ্রহ।
তৃতীয় চারের ফের দ্বিতীয়টির প্রতিক্রিয়ার অংশ। ১৯৭৬ সালে মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মাওপন্থীরা হেরে গিয়ে তাদের চারজন পরিচিত হলেন 'Gang of Four'- চার কুচক্রী নামে। অপরাধ- সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বাড়াবাড়ি। চতুর্থ 'চার'টি ভদ্র। তাকে ফের বলা যাবে কি না, নির্ভর করে বিচারকর্তা কে। এই 'চার'-এর নাম 'Four Modernization'- চার আধুনিকায়ন। মাও পরবর্তী দেং শিয়াও পিংয়ের চীনের সংস্কার প্রক্রিয়ার সূচনাকারী কর্মসূচী।
পাঠক, আপনার এমন কোনো তথ্য জানা আছে, যেখানে একটি দেশ পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত- কোনোভাবে তার নিজ দেশের কোনো একটি পাখিকে হত্যা করে নির্বংশ করেছে? নিশ্চিহ্ন করেছে?
মনে হয় আপনার জানা নেই। কিন্তু ঠিক তাই ঘটেছিল সমাজতান্ত্রিক চীনে, ১৯৫৮ সালে তথাকথিত 'সম্মুখে বৃহৎ উল্লম্ফন' (Great Leap Forward) সময়কালে। আর সেই নিরীহ বেচারা পাখিটি কোনো সাতে-পাঁচে নেই, ছোট্ট চড়ুই৷ সেই প্রথম চারের ফের: Four Pest Campaign- চার কীটপতঙ্গ অভিযান।
কিন্তু চড়ুইয়ের এই করুণ কাহিনির আদ্যোপান্ত বুঝতে আপনাকে মাও সে তুংয়ের বৃহৎ উল্লম্ফন আন্দোলন সম্পর্কে একটু জানতে হবে। বিপ্লবের পর চীন পুরোপুরি সোভিয়েত ধাঁচে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এটি ছিল ভারী শিল্পভিত্তিক পরিকল্পনা। এতে সেভাবে শ্রমিক নিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি। তাছাড়া বড় কথা, ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমুনিস্ট পার্টির ২৫তম কংগ্রেসে শ্রমিকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য আর্থিক প্রণোদনার সুপারিশ করা হয়।
মাও সে তুং একে পুঁজিবাদী পথে প্রত্যাবর্তন বললেন। তিনি নিজস্ব পথে চলতে চাইলেন। একটি স্লোগান তুললেন, দু'পায়ে হাঁটা। অর্থাৎ একই সময়ে শিল্প ও কৃষি উন্নয়ন, একইসঙ্গে পুঁজিঘন ও শ্রমঘন উৎপাদন ব্যবস্থা, একইসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার... ইত্যাদি।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ আন্দোলনের সময়কাল। আকাশচুম্বী, সম্পূর্ণ অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলো। তিন বছরে প্রধান প্রধান কয়েকটি শিল্প ও কৃষিদ্রব্যে ইংল্যান্ড, আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য স্থির হয়। এ বিশাল কর্মযজ্ঞে তো শুধু পুরুষ শ্রম যথেষ্ট হবে না। মাও সে তুং উদ্ভাবন করলেন কৃষিতে গণ কমিউন। পারিবারিক রান্না-বান্না খাওয়া হবে না। কমিউনের মেসে সবাই খাবে। মহিলারা সবাই কাজ করবেন। বাচ্চা-কাচ্চাদের রাখা হবে কেয়ার সেন্টারে। ছোট ছোট হাঁড়ি-কড়াই সব বড় বড়তে রূপান্তর করা হলো। বিউগল সকালে বাজলে উঠে মাঠে কাজে যেতে হবে। সমস্ত চীন জুড়ে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ।
মাও সে তুং বৃহৎ উল্লম্ফনের প্রথম বছর ১৯৫৮ সালে 'Four Pest Campaign'-এর ডাক দিলেন- মশা, ইঁদুর, মাছি ও চড়ুই নিধন অভিযানে। বিজ্ঞানীরা বললেন, একটি চড়ুই বছরে সাড়ে ৪ কেজি দানাশস্য খেয়ে ফেলে। চড়ুই নিধনের নাম দেওয়া হলো 'Eliminate sparrows Campaign' (Xiamie Maque Yundong)- চড়ুই নির্মূল অভিযান। সমগ্র দেশব্যাপী লোকজন চড়ুইয়ের বাসা ভাঙা, ডিম ভাঙা, ছানা মেরে ফেলা, গুলি করে মারায় সামিল হলো। আর যাতে চড়ুই স্থির হয়ে না বসতে পারে কোথাও, সেজন্য ড্রাম, থালা, বাটি ইত্যাদি বাজানো হতো। একসময় এত শব্দে চড়ুইরা প্রাণত্যাগ করত।
একদিন পিকিং শহরে সেনা, ছাত্র-ছাত্রী, লোকজন মিলে কয়েক লাখ লোক চড়ুই নিধনে নেমে পড়ে। বেচারারা কোথাও তিষ্টোতে না পেরে কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসে ঢুকে পড়ে। পোল্যান্ডের দূতাবাস ওদের তাড়িয়ে দিতে অস্বীকার করলে ব্যাপক লোকজন পোলিশ দূতাবাস ঘিরে বিকট বাজনা বাজাতে থাকে। পরিণামে দূতাবাসের চৌহদ্দির মধ্যে ব্যাপকসংখ্যক চড়ুই মারা পড়লে সরাতে তাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
প্রায় চড়ুইশূন্য হয়ে গেল গণচীন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা কমপক্ষে ৬০ কোটি চড়ুইয়ের গণহত্যা ঘটেছিল চীনে তখন।
মাও সে তুংয়ের নিজস্ব হঠকারী এই বৃহৎ উল্লম্ফন আন্দোলনের দ্বিতীয় বর্ষে ১৯৫৯ সাল থেকে শুরু হয় নজিরবিহীন মহাদুর্ভিক্ষ। লৌহযবনিকার বাইরে কোনো খবর পৃথিবী পায়নি। কমপক্ষে পাঁচ কোটি মানব সন্তান প্রাণ হারায় সেই মহাদুর্ভিক্ষে। 'Cannibalism'- নরমাংস ভক্ষণ বহু জায়গায় ঘটেছিল। দুর্ভিক্ষের কারণ যেমন আংশিক ছিল প্রাকৃতিক খরা, তেমনি ছিল মনুষ্যনীতি সৃষ্ট।
১৯৬০ সালে একজন পক্ষীবিশারদ (Ornithologist) Tso Hsin Cheng বলেন যে, চড়ুই শুধু খাবার খায় না। পোকা-মাকড় খায়, কীটপতঙ্গ খায়। এতে ফসলের উপকার হয়। দেশ চড়ুইশূন্য করার পর ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। পঙ্গপালে ছেয়ে যায় দেশ। মাও সে তুং নীতি আংশিক পরিবর্তন করেন। কিন্তু যা ঘটার তা তো ঘটেই গিয়েছে।
১৯৬০ সালে Four Pest Campaign-এ চড়ুইকে রেহাই দিয়ে তার স্থলে ছারপোকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর চড়ুইশূন্য চীনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লক্ষ চড়ুই আমদানি করা হয়।
হায় প্রাণীকূল! গণহত্যা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বিচার শুধু তো মানুষের জন্য। আমরা মনুষ্যকূল তো শ্রেষ্ঠজীব। তোমরা বিচার পাবে কেন? অন্য সব প্রাণীর ওপর এ প্রজাতির নিরঙ্কুশ অধিকার। 'No holds barred'!
তবু তো কোনো কোনো মানুষের প্রাণ শুধু পশু-পাখির জন্য নয়, গাছপালার জন্যও কাঁদে। ছিঁড়ে নেওয়া ফুলের জন্যও কাঁদে। মনে নেই সেই বিখ্যাত গানটির কথা, হোক না প্রতীকী অর্থে? মানুষ খুন হলে পরে, মানুষে তার বিচার করে, নেই তো খুনির মাফ, তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ, বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া নিহত গোলাপ।
অদ্ভুত বৈসাদৃশ্যের জীব মানুষ।
- লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়