নত হও প্রকৃতির কাছে প্রতিনিয়ত
গত বেশ কিছুদিন ধরে বিপুল বিস্ময়ে এক অভূতপূর্ব ঘটনা অবলোকন করছে বিশ্ব। একটি ভাইরাসের আক্রমণে থমকে আছে সবকিছু। আধুনিকতম সময়ে এ বিশ্ব আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় নি। বিস্ময় ধীরে ধীরে সয়ে আসছে। গত ডিসেম্বরে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে চীন যেভাবে আক্রান্ত হয়েছিল ও তার ব্যবস্থাপনা করেছে, আমাদের কাছে তখন তা খুব প্রভাব ফেলেনি। যদিও হুবেই প্রদেশের উহানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের নিয়ে আসায় আমাদের দেশ উদ্যোগ নিয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশ হিসেবে খ্যাত ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্রেও পরবর্তীতে বড় আঘাত হানল করোনা। করোনা আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি এসব দেশের জন্য এ শতাব্দীতে নতুন। ক্রমশ বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ল কোভিড-১৯। ভাইরাসটিকে মহামারী ঘোষণা করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে আমাদেরও বেশ করে ভাবিয়ে তোলে যখন বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে ইতালি থেকে দেশে ফেরা মানুষের ঢল নামে। বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণের সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে বহু প্রামাণ্য লেখা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু সেটার চাইতেও আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ- এই মহামারির দুর্যোগ আমাদের কি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে? আমরা কি সেটা অনুধাবন করতে পারছি?
পৃথিবীতে এর আগে গুটিবসন্ত, কলেরা, প্লেগ, ফ্লু যখন মহামারি আকারে এসেছিল তখন এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ভয়াবহ কম থাকলেও বিভিন্ন প্রান্তের সাথে চলাচল সহজ না হওয়ায় এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েনি। বিশ্বায়ন আমাদের জীবনযাত্রাকে যান্ত্রিকভাবে সহজতর করে তুললেও একই সঙ্গে আমাদের ভাবতে শেখাল- খুব তুচ্ছ কারণেও ঘটে যেতে পারে এর সমাপ্তি, শেষ হয়ে যেতে পারে সবকিছু।
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের উপর নির্ভর করে, অন্য দেশের সম্পদ লুট করে বা অন্যায্য বাণিজ্য দিয়ে পুঁজির বিস্তার ঘটিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কল্যাণ রাষ্ট্রের ভূমিকায় বর্তমানে অবস্থান করলেও পূর্বের ঔপনিবেশিক শোষণের রক্তের দাগ ঢাকতে পারেনি। এ বিশ্ব পুঁজির বিপুল বিস্তার ঘটিয়ে আদতে মানব কল্যাণের জন্য কতটুকু কি করতে পেরেছে- মানুষকে অনিয়ন্ত্রিত ভোগবাদী বানিয়ে তোলা ছাড়া? ভোগের রসদ যোগাতে ক্রমশ দানবীয় জন্তুতে পরিণত হচ্ছে মানুষ। তাই কেউ অবাক হবে না যদি স্থিরভাবে প্রমাণিত হয় যে, সার্স কোভ ২ (SARS COV 2) বা কোভিড-১৯ পরাশক্তিকে শায়েস্তা করতে বা বাণিজ্যিক ফায়দা লুটতে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট (যদি এখন পর্যন্ত এর কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।)
বিশ্বের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর অনৈতিক ও প্রকৃতি ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ডের ফলে জীবনযাত্রার তথাকথিত মানের উন্নয়ন ঘটলেও, বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য যে জীবন দক্ষতা দরকার তা দ্রুত হারিয়ে গেছে। তাই ফসল ফলানো বা কৃষি এখন সবচাইতে অবহেলিত, অথচ খাদ্য ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্ন, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা এই মৌলিক বিষয়গুলো সমগ্র বিশ্ব এতটাই পুঁজির দাপটে বাণিজ্যিকীকরণ করে তুলেছে যে এই অতি প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে মানুষকে অমানবিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে বাধ্য হতে হচ্ছে। আমরা অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছি ক্রমশ কিন্তু কিসের বিনিময়ে?
বাংলাদেশের পরিবেশ ধ্বংস এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ ক্ষীণতর। যে নৈতিকতার মানদণ্ড আমরা সভ্যতার ক্রমবিকাশে দাঁড় করিয়েছি তা আসলে কতটুকু সঠিক তা ভাববার সময় এসেছে। উন্নত দেশগুলোর ভোগবাদীতার অনুকরণে আমরা আরও নিকৃষ্টতর অনুসরণ নীতি গ্রহণ করেছি।
এই দেশটির অধিকাংশ মানুষ ধার্মিক কিন্তু ভয়াবহ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছে শুধুমাত্র ভোগবাদীতার প্রতি প্রগাঢ় লোভ থেকেই। তাই ধর্মাচরণের লেবাস কুৎসিতভাবে বাড়ছে কিন্তু যেসব অসততা ধর্ম নিষেধ করে তা প্রকাশ্যে বা গোপনে করতে কোন দ্বিধা নেই, চরম অসততার আর দুর্নীতির বিনিময়ে অর্জিত অর্থ তাই ধর্মের ক্ষতিকর দিকের পেছনেই বিনিয়োগ হচ্ছে।
আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তির ঘটনা শিল্প-সাহিত্য-চারুকলায় ব্যাপক ধ্বস নামিয়ে দিয়েছে। গণমাধ্যমের নাক্কারজনক পক্ষপাত দুষ্ট কোটা প্রথা সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যই বদলে দিয়েছে। সবাই খ্যাতির লোভে, পুঁজির সেবায় ব্যস্ত। কুরুচিপূর্ণ সস্তা জনপ্রিয়তা সন্ধানীরা গণমাধ্যম আর বিবেচনাশক্তি-লুপ্ত পাঠক-দর্শক দ্বারা সমাদৃত। অথচ মানুষের মানবিকতা ও সমাজের সৃজনশীল বিকাশে সৃজনশীলতার চর্চা অপরিহার্য।
শিল্প সাহিত্যের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার ও অর্থ উপার্জন মনস্কতা বিগত দিনগুলোতে আমাদের ১৮ কোটি জনগণের দেশে আর একজনও আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম দিতে পারে নি ।
শিশুদের নানাভাবে সংস্কৃতি কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখার প্রবণতা লক্ষণীয়, যতটুকু আছে তা অসুস্থ প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক।
সমাজের এ বিবর্তন নিয়ে যে গবেষকরা গবেষণা করবেন তাদের অবস্থা আরও করুণ। মুখোশ পড়া জীবনের কতরূপে তারা নিজেদের প্রকাশে ব্যস্ত। সময় কই গবেষণার? এ দেশে না পোষালে যে কোন মুহূর্তে পারেন তারা, জমানোর সব আয়োজন তৈরি করা আছে।
তবে এত সব হতাশার মাঝেও আশার কথা আমাদের ভাবতে হবে। আজ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছি একটি ভাইরাসের কারণে কিন্তু সমগ্র ব্যবস্থা যে জঘন্যতম বাণিজ্যিক করে তোলাতে শুধু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা চিকিৎসক নয়, আমাদের নিরবতাও দায়ী। চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে বাণিজ্যকে সরিয়ে দিতে না পারলে মানবিক সমাজ নির্মাণ একটি ফাঁকা বুলিই রয়ে যাবে।
কৃষি সবার জন্য প্রায়োগিক বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। মাটি না ধরলে মাটির প্রতি ভালবাসা জন্মাবে কেমন করে! শিখতে হবে কৃষি উৎপাদন, তাহলেই প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা জন্মাবে।
বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয় দক্ষতা যেমন ঘরবাড়ি আসবাব, কলকব্জা, ইলেকট্রিকের ছোটখাটো মেরামত, রং করা, রান্না করা এসব অর্জন করতে হবে সরল জীবন যাপনের জন্য।
বিশ্বায়ন বা বৈশ্বিক গ্রাম কোনটাই আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে নি। কৃষি হয়েছে পরনির্ভরশীল, অধিক উৎপাদনের জন্য আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিষাক্ত কৃষি অর্থনীতির কবলে ফেলা থেকে এখুনি ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
শিল্প বলতে প্রায় পুরোটাই আমাদের পরিবেশ, কৃষি জমি, নদ নদী ধ্বংস করে। একটা সস্তা রপ্তানি পণ্য টি-শার্ট বা জিন্সের প্যান্ট উৎপাদনের জন্য প্রকৃতি থেকে বিনামূল্যে কত টাকার উপাদান অপচয় করছি আমাদের হিসেব করা শিখে এর দাম নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের এ হিসেব পশ্চিমাদেরও অধিক ভোগ থেকে দূরে সরাবে।
মোদ্দা কথা জীবনকে আরও সরলীকরণে বৈশ্বিক এ মহাদুর্যোগ আমাদের যে ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে তা থেকে কিছুটা সুফল পেতেই হবে। নির্মাণ করতে হবে এমন মানবিক সমাজ যেখানে ক্ষুধা পেটে কেউ এক বেলা থাকবে না, চিকিৎসার জন্য কাউকে ভাবতে হবে না।
ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিবেশ যেমন এই করোনাকালে দেখাল- আর একটু কম ভোগ করলে আমাদের এই পৃথিবীটা কত সুন্দর থাকত। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে যেন আমাদের মনোযোগ থাকে প্রকৃতির উপর কম অত্যাচারে জীবন যাপনের। শিখতে হবে নত হতে প্রকৃতির কাছে প্রতিনিয়ত।
লেখক: পেশায় একজন উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। নাট্যমঞ্চে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন বাংলাদেশের প্রধানতম নাট্যদল থিয়েটার-এর হয়ে।