পঞ্চাশে বাংলাদেশ: জলবায়ু পরিবর্তন কেন ধ্বংস করে দিতে পারে আমার পিতৃভূমি?
'তুমি কি একটু এসিটা চালাবে? এখানে এত গরম!,' বলে উঠলাম আমি। কিন্তু মনে হলো না বড়রা কেউ আমার কথা শুনতে পেয়েছেন। উল্টো মা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন এই ঘ্যানঘ্যান চলতে থাকলে গরমের চেয়েও বাজে জিনিস আমার কপালে আছে।
আমরা আমাদের পিতৃপুরুষের ভূমি বাংলাদেশে এসেছি দাদা-দাদি ও গ্রাম দেখতে। সারাক্ষণই আমায় মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটাই আমার শেকড়।
ছোটবেলায় আমি ছুটিছাটায় কিছুদিন গ্রামে কাটাতাম। তখন দিনগুলো কেটেছে ছোট ভাই-বোনদের সঙ্গে ধানক্ষেতে ঘুরে বেরিয়ে, মাঠে গরু চরিয়ে কিংবা পুকুর বা বিলে মাছ ধরা দেখে। পুরো গ্রামটাই ছিল আমাদের জন্য একটা খেলার মাঠ এবং দুষ্টুমি ও আনন্দের জায়গা। কিন্তু যতই বড় হয়ে উঠেছি, গ্রামের সেই মোহনীয় রূপ চোখের সামনে থেকে সরে গেছে।
আমার মনে আছে, ছোটবেলায় যেবার গ্রামে গেলাম, এয়ারপোর্ট থেকে গ্রাম পর্যন্ত যে গাড়ি আমাদের নিয়ে গিয়েছিল, তা আমাদের গ্রামের সামনে থামল এবং আমরা দেখলাম, সামনের রাস্তা পুরোটাই পানির নিচে।
আমরা তখনো বাড়ি থেকে আধ ঘণ্টা দূরত্বে। কিন্তু যাত্রাপথে এই অপ্রত্যাশিত মোড় আমাদের 'নৌকা' নামক বাহনে উঠতে বাধ্য করল। অর্থাৎ, ঘোলা সবুজ পানির ওপর দিয়ে নৌকায় আরও দু-তিন ঘণ্টা যেতে হবে।
এসব ১৫ বছর আগের ঘটনা। আর সেটাই ছিল আমার সর্বশেষ বাংলাদেশ ভ্রমণ।
আমার মা রত্না এবং আমি পুরনো দিনের ছবির অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এসব গল্প করছিলাম। ছবিগুলোয় সেই নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশন, 'বাজে' হেয়ারকাট এবং সেইসঙ্গে আমাদের বাংলাদেশ, যাকে মা 'সবুজের সমুদ্র' বলেন। তিনি আরও বলছিলেন, 'তোমার বাবা স্বপ্ন দেখেন শেষ দিনগুলো নিজের দেশের মাটিতেই কাটানোর; কিন্তু তা তো সত্যি হবে না। তবে তোমার জানা দরকার, ওখানে আমাদের কী কী আছে; কারণ এসবের উত্তরাধিকারী তো তুমিই।'
আমার বাবা বাংলাদেশেই বড় হয়েছেন এবং তিনি রুটিন মাফিক দেশে যান, নিজের সহায়-সম্পদ দেখাশোনা করেন, নিজের স্কুলে যান এবং গ্রামের মানুষদের সঙ্গে গল্প-গুজব করেন। আমি ছোট থেকেই শুনে আসছি, বাবা আমাদের দুই ভাই ও বোনের হাতে গ্রামের বাড়িটা দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে দেবেন। কিন্তু সেসব এখানে আর আলোচনা না-ই করি। কারণ প্রায়ই এসব আলোচনা শেষ হয় নীরবতার মধ্য দিয়ে।
অন্যসব ব্রিটিশ-বাংলাদেশির মতো আমার বাবাও নিজ গ্রামের মানুষদের সাহায্য করতে চাইতেন সবসময়। তিনি সেখানে রাস্তা ও মসজিদ নির্মাণ, চাষাবাদের যন্ত্রপাতির জন্য চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে অনেকের হাসপাতালের বিলও মিটিয়েছেন।
বছরের পর বছর ধরে বার্মিংহামে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করে তিনি যা উপার্জন করেছেন, তার অর্ধেকটাই গ্রামে জমি কেনার পেছনে চলে গেছে- যা তার প্রপ্রপিতামহের নামে রাখা হয়েছে।
প্রতি গ্রীষ্মেই বাবা আমায় বলেন তার সঙ্গে গ্রামে গিয়ে সাহায্য করতে। কিন্তু প্রতিবারই আমি মাথা নেড়ে জানাতাম, 'আমার সময় হবে না।'
আমার দাদিই আমাদের পরিবারের একমাত্র সদস্য- যিনি এখনো গ্রামের বাড়িটায় থাকেন। তিনি ছাড়া বাকি সবাই একের পর এক যুক্তরাজ্য, কানাডা কিংবা আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন।
কিন্তু আমার বাবার মতে, গ্রামে সবকিছু ভেঙে পড়ছে। সেখানে কেউ না থাকায় এবং যত্নও না নেওয়ায় সবকিছু জনশূন্য হয়ে পড়ছে।
মা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আমার বাবার প্রজন্মের সবাই গ্রামেই বড় হয়েছেন, তারা এই বাড়িকে দাঁড় করাতে পরিশ্রম করেছেন। তাই তিনি চান না নিজের ভিটেটুকু হারিয়ে যাক।
এসব কথা আমি অসংখ্যবার শুনেছি, তবে এখনো পর্যন্ত আমাদের সবকিছু হারিয়ে যায়নি ওখানে।
এর কারণ হতে পারে, আমি এখন নিজেদের ইতিহাস ও শেকড় সম্পর্কে সচেতন হতে শিখেছি। ব্রিটিশ-বাংলাদেশি হিসেবে আমরা এখন আমাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে গর্বিত এবং আমাদের মধ্যকার বাংলাদেশি রূপটা আরও বেশি করে খুঁজে পেতে চাই।
আবার এমনও হতে পারে, আমার সেই কিশোর বয়সে কিংবা বিশের কোঠায় এসে আমি যা বুঝতে পারিনি, তা এখন বুঝছি। তখন আমি গ্রামে নিজেদের ছোট্ট জায়গা বাঁচানোর চেয়ে দেশ-বিদেশ জয়ের দিকে বেশি আকৃষ্ট ছিলাম।
এক প্রস্ত ধূসর রেখা
এখন যদিও আমি নিজের দেশের বাড়ি বাঁচাতে বাবাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত, কিন্তু অন্য একটি বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর সেটি অবহেলা ও ঔদাসিন্যের চেয়ে অনেক বেশি জটিল সমস্যা, যার নাম হলো- জলবায়ু পরিবর্তন।
বাংলাদেশ বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের উপকেন্দ্রে রয়েছে। এই দেশের ৮০ শতাংশ অঞ্চলই বন্যাপ্রবণ এবং দেশটি সহজেই বন্যা, ঝড়ঝঞ্ঝা, নদী ভাঙন, সাইক্লোন ও খরার শিকার হয়। মারাত্মক পরিবেশ দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নিয়ে করা বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
বাংলাদেশ সরকারের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভার্নমেন্ট রিসার্চের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, 'আমি প্রায়ই মজা করে বলি, বাংলাদেশ হচ্ছে সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঈশ্বরপ্রদত্ত গবেষণাগার। একমাত্র আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ছাড়া আমাদের ওপর সব রকমের দুর্যোগ আঘাত হানে।'
অধ্যাপক নিশাত মনে করেন, যদি আমরা এখনই গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা কমাতে না পারি, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
-
লেখক: একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি তরুণ - বিবিসি থেকে অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া